ইসরোর গগনযান মহাকাশযান প্রকল্পে বিলম্বের পিছনের কারণ কী?

ভারতের গগনযান (Gaganyaan) মানব মহাকাশযান প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবী কক্ষপথে মানব মহাকাশচারী প্রেরণ করা, তবে এই প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত পিছিয়ে…

India's Gaganyaan Human Spaceflight Programme

ভারতের গগনযান (Gaganyaan) মানব মহাকাশযান প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে পৃথিবী কক্ষপথে মানব মহাকাশচারী প্রেরণ করা, তবে এই প্রকল্পের অগ্রগতি এখন পর্যন্ত পিছিয়ে গেছে। ভারতের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) ২০১৯ সালে গগনযান প্রকল্পের সূচনা করেছিল এবং দ্রুততার সঙ্গে এই প্রকল্পে সফলতা অর্জন করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিং রাজ্যসভায় দেওয়া একটি লিখিত উত্তরে এই প্রকল্পের বিলম্বের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি জানিয়ে দেন যে, কোভিড-১৯ মহামারী, সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনগুলির কারণে গগনযান প্রকল্পের সময়সীমা পেছানো হয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব
গগনযান প্রকল্পের বিলম্বের মূল কারণগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে কোভিড-১৯ মহামারী। এই মহামারীর কারণে শুধুমাত্র ভারতের নয়, সারা পৃথিবীর উন্নয়নমূলক কাজেই ব্যাঘাত ঘটে। ISRO-র গগনযান প্রকল্পের জন্য বিশেষ ধরনের নতুন যন্ত্রপাতি এবং উপকরণ তৈরি করা হচ্ছিল। কোভিড-১৯ অতিমারীর কারণে এই যন্ত্রপাতির সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছিল এবং সেসব উপকরণের ডেলিভারি নিয়মিত হয়নি।

   

বিশেষত, গগনযান প্রকল্পের জন্য যে নতুন এবং অত্যাধুনিক মহাকাশ সরঞ্জামগুলি তৈরি করা হচ্ছিল, তাদের মধ্যে পণ্য সরবরাহ ও সেগুলির সংযোজনের প্রক্রিয়া অনেকটা পিছিয়ে যায়। এর ফলে প্রকল্পের সূচি অনেকটা বিলম্বিত হয়।

লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের উন্নয়ন
ISRO প্রথমে গগনযান প্রকল্পের জন্য লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করার পরিকল্পনা করেছিল। তবে পরবর্তীতে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে, এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিটি দেশীয়ভাবে তৈরি করা হবে। এই সিদ্ধান্তও প্রকল্পের সময়সীমা আরো পিছিয়ে দেয়। দেশীয়ভাবে লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করতে গেলে কিছু সময় প্রয়োজন, বিশেষত যখন নতুন প্রযুক্তির জন্য পরীক্ষামূলক কাজ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম করা হয়।

গগনযান ক্রু মডিউলের পরিবর্তন
গগনযান প্রকল্পের মূল পরিকল্পনায় দুটি অক্রু মিশন এবং একটি ক্রু মিশন ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে এই পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ISRO এখন এই প্রকল্পের আওতায় ৬টি অক্রু মিশন এবং ২টি ক্রু মিশন চালানোর পরিকল্পনা করছে। এসব মিশনের লক্ষ্য হবে নতুন প্রযুক্তি পরীক্ষা করা, বিশেষত গগনযান ক্রু মডিউল এবং মানব-বহনযোগ্য লঞ্চ ভেহিকল মার্ক ৩-এর নিরাপত্তা যাচাই করা। এর মাধ্যমে, মহাকাশযানটি কক্ষপথে মানুষের জীবন নিরাপদ রাখতে এবং পৃথিবীতে ফিরে আসার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হবে।

প্রকল্পের লক্ষ্য এখন শুধু মানব মহাকাশযান পাঠানোই নয়, বরং ভারতের নিজস্ব অরবিটাল স্টেশন ‘ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন’ (Bharatiya Antariksh Station) স্থাপনের প্রক্রিয়াও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যেখানে দেশীয় প্রযুক্তি ও সক্ষমতা প্রদর্শন করা হবে।

গগনযান প্রকল্পের জন্য আর্থিক বরাদ্দ
এই প্রকল্পের জন্য সরকার যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করেছে, তাও সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে। জিতেন্দ্র সিং জানান, গগনযান প্রকল্পের জন্য মোট বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ২০,১৯৩ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ গগনযান প্রকল্পের নতুন সম্প্রসারিত কর্মসূচি এবং ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল পূরণ করবে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে সরকার গগনযান প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ১১,১৭০ কোটি টাকা অনুমোদন করেছে।

এই অতিরিক্ত বরাদ্দের মাধ্যমে গগনযান প্রকল্পের সব মিশন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, এবং ভবিষ্যতের মহাকাশ অভিযানগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হবে।

২০২৫ সালে গগনযান মিশনের প্রস্তুতি
ISRO-র পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৫ সালের মধ্যে গগনযান প্রকল্পের জন্য একাধিক অক্রু ফ্লাইট পরিচালিত হবে। এসব মিশনে নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা এবং মহাকাশযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। পরবর্তী বছরগুলিতে ক্রু মিশন পরিচালনার মাধ্যমে ভারতের মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা হবে।

২০২৬ সালে প্রথম ক্রু মিশন পরিচালিত হওয়ার পর, ISRO আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা ও মিশন চালাবে, যার মধ্যে থাকবে ‘ভারতীয় আন্তরিক্ষ স্টেশন’ এর মূল মডিউল স্থাপন। এই স্টেশনটি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
গগনযান প্রকল্পের বিলম্বের পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যার মধ্যে কোভিড-১৯ মহামারী, সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত। তবে ISRO-এর শক্তিশালী নেতৃত্ব এবং সরকারের সমর্থনের মাধ্যমে প্রকল্পের কাজ অব্যাহত রয়েছে। ২০২৫ সাল থেকে গগনযান প্রকল্পের বিভিন্ন মিশন সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে, ভারত মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।