পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে রাজ্যের আর্থিক কর্মকাণ্ডে একটি গভীর ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজ্যের রাজস্ব ব্যয় বাড়ছে দ্রুতগতিতে, কিন্তু মূলধনী ব্যয়ে সেই অনুপাতে বৃদ্ধি না হওয়ার কারণে রাজ্যের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি রেটিং এজেন্সি কেয়ারএজড (CareEdge)-এর এক রিপোর্টে এই তথ্য উঠে এসেছে।
রাজস্ব ও মূলধনী ব্যয়ের বৈষম্য
রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ব্যয়ে বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ১৩.৫ শতাংশ। বিপরীতে, মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৭.৭ শতাংশ, যা বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেকটাই কম।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মুখ্য উপদেষ্টা এবং অর্থ দপ্তরের মুখ্য উপদেষ্টা অমিত মিত্র সম্প্রতি জানিয়েছেন যে, ২০১০-১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মূলধনী ব্যয় ছিল ২,২২৬ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে তা বেড়ে বাজেট অনুযায়ী ৩৫,৮৬৫.৫৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। যদিও বাস্তব চিত্রে এই ব্যয় বৃদ্ধি যথেষ্ট মন্থর।
কেন কমছে মূলধনী ব্যয়?
কেয়ারএজড রিপোর্টে জানানো হয়েছে, রাজ্যগুলির রাজস্ব ব্যয়ের বৃদ্ধি একটি সাধারণ প্রবণতা। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন, যেমন: বিভিন্ন ভাতা, আয়ের সহায়তা এবং ঋণ মকুবের মতো পদক্ষেপগুলির কারণে রাজস্ব ব্যয় বাড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি ১২ লক্ষ উপভোক্তাদের জন্য একটি আবাসন প্রকল্পে তহবিল বরাদ্দ করেছেন। এই ধরনের জনমুখী প্রকল্পগুলি রাজস্ব ব্যয় বাড়ালেও মূলধনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারছে না।
আর্থিক ঘাটতির উচ্চ হার
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথমার্ধে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক ঘাটতি দাঁড়িয়েছে রাজ্যের স্থূল আঞ্চলিক গার্হস্থ্য উৎপাদনের (GSDP) ৩.৭ শতাংশে। এটি ১৫তম অর্থ কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী নির্ধারিত ৩ শতাংশ সীমার চেয়ে অনেকটাই বেশি।
দেশের ২০টি শীর্ষ রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ঘাটতির হার সবচেয়ে বেশি। যেখানে এই রাজ্যগুলির গড় আর্থিক ঘাটতি GSDP-র ২.৯ শতাংশ, সেখানে পশ্চিমবঙ্গের উচ্চ ঘাটতি রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রতি গভীর চ্যালেঞ্জের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
উন্নয়নের ওপর প্রভাব
মূলধনী ব্যয়ের মন্থরতার কারণে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলধনী ব্যয় বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমার্ধে মূলধনী ব্যয়ের কম হার এবং রাজস্ব ব্যয়ের দ্রুত বৃদ্ধি রাজ্যের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
কেন্দ্রীয় আর্থিক পরিস্থিতি
কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রেও একই ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের প্রথম সাত মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক ঘাটতি ছিল ৭.৫ ট্রিলিয়ন টাকা, যা বাজেট অনুমানের ৪৬.৫ শতাংশ।
উন্নয়নের দিশা
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নির্বাচনের পরবর্তী পর্যায়ে মূলধনী ব্যয় কিছুটা বাড়লেও, বাজেটে নির্ধারিত স্তরে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কম। রাজস্ব ব্যয়ের তুলনায় মূলধনী ব্যয়ের অনুপাত বাজেটের তুলনায় কম থাকবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য মূলধনী ব্যয়ের ক্ষেত্রে জোর দেওয়া জরুরি। তবে, রাজ্যের বর্তমান প্রবণতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে।
পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক কাঠামোর বর্তমান চিত্র রাজস্ব ব্যয় এবং মূলধনী ব্যয়ের মধ্যে বৈষম্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণের জন্য রাজস্ব ব্যয় বাড়ালেও, অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান ব্যয়সমূহ পিছিয়ে যাচ্ছে।
যদি দ্রুত এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া না যায়, তবে রাজ্যের আর্থিক কাঠামো আরও চাপে পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে মূলধনী ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। রাজ্যের অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষা করতে এই উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।