বাংলাদেশে বর্তমানে চলমান অশান্তির সুযোগ নিয়ে নিষিদ্ধ ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন হিজবুত তাহরীর (Hizb ut-Tahrir) আবার সক্রিয় (active) হয়ে উঠেছে, যা গোয়েন্দা (Intelligence) সংস্থাগুলোর জন্য একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, এবং বর্তমানে ভারতেও তাদের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করছে। সম্প্রতি গোয়েন্দা রিপোর্টে (Report) বলা হয়েছে, সীমান্ত ঘেঁষা বিভিন্ন রাজ্য (states)— বাংলায় (Bengal) বিশেষ করে দক্ষিণ দিনাজপুর, কোচবিহার, মালদা, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ— জেলায় (districts) সতর্কতা জারি করা হয়েছে, কারণ এসব অঞ্চলে হিজবুত তাহরীরের সক্রিয়তার সম্ভাবনা রয়েছে।
হিজবুত তাহরীর একটি আইসিস-পন্থী ইসলামিক সংগঠন, যা পৃথিবীর ৫৭টি দেশে সক্রিয় এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম প্রচার করে। সংগঠনটি মূলত মুসলিম বিশ্বের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্য কার্যক্রম চালিয়ে থাকে এবং ইসলামিক সামরিক বাহিনী তৈরি করার কথাও প্রকাশ্যে বলে থাকে। ২০১০ সালে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও এই সংগঠনটি ভারতসহ অন্যান্য দেশে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখে ভারত সরকারও হিজবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তবে তারা এখনো বিভিন্ন রাজ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
গোয়েন্দাদের রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, হিজবুত তাহরীর জামায়েত উল মুজাহাদিন (জেএমবি) এবং আল কায়দার উপধারা হিসেবে কাজ করছে। হিজবুত তাহরীর মূলত জেএমবির মতো সংগঠনের স্টাইল অনুসরণ করে, এবং তারা এখন পরিযায়ী শ্রমিকদের টানানোর চেষ্টা করছে। বিশেষত দক্ষিণ ভারতে যারা কাজ করতে যান, তাদের টার্গেট করে স্লিলার সেল (ধীরে ধীরে সংগঠিত সদস্য) গঠন করছে। এসব সদস্য পুরোনো হুজি এবং জেএমবির নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নতুন সদস্য সংগ্রহের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া, গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা হিজবুত তাহরীরকে লজিস্টিক এবং অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করছে, যা সংগঠনের কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করছে।
ভারতীয় সীমান্তে হিজবুত তাহরীরের তৎপরতা বাড়ানোর পেছনে আরও একটি কারণ হলো বাংলাদেশে সংগঠনের নানা ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সক্রিয় ভূমিকা। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার অস্থিতিশীলতা এবং পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় হিজবুত তাহরীর নাশকতা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলি সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি, হিজবুত তাহরীরের সেল গুলোর বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ নিচ্ছে।
এদিকে, সীমান্তের আশেপাশে গোয়েন্দাদের সতর্কতা আরও তীব্র করা হয়েছে। বিশেষত মালদার মেহেদিপুর সীমান্ত থেকে সম্প্রতি পাওয়া গোপন সূত্রে জানা গেছে, দুই যুবক—আমির ও মারুফ—পাসপোর্ট নিয়ে বৈষ্ণবনগরে এসে কয়েকটি বৈঠক করেছেন। এরপর তারা মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ানে চলে গিয়েছিলেন, যেখানে তারা আরও কিছু বৈঠক করেন। গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন সিমির সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং অপরজন হিজবুত তাহরীরের পুরোনো নেতা ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থা তাদের গতিবিধি ট্র্যাক করেছে এবং মনে করছে, এই বৈঠকগুলো নাশকতার পরিকল্পনার অংশ ছিল।
অন্যদিকে, ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর দাবি, খাগড়াগড় বিস্ফোরণের পর থেকেই জেএমবি পশ্চিমবঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তার পরবর্তী সময়ে এই সংগঠনটির শক্তি বৃদ্ধি পায়। ২০১৪ সালে শেখ হাসিনাকে খুন করার পরিকল্পনাও ছিল জেএমবির, এবং তাদের এই কর্মকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলি মনে করছে, হিজবুত তাহরীরের সক্রিয়তার কারণে এই বেস (অথবা নেটওয়ার্ক) আবার নতুন করে সংগঠিত হতে পারে, যা রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বিপদ সৃষ্টি করতে পারে। তাই, সীমান্তে এবং রাজ্যের অভ্যন্তরে সজাগ নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
এছাড়া, গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা গেছে যে, সীমান্তে অতিরিক্ত নজরদারি চালানোর জন্য বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) সম্প্রতি ড্রোন উড়িয়ে পরিদর্শন করেছে। এই ড্রোনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী কার্যক্রম এবং অবৈধ সীমান্ত পারাপারের চেষ্টা শনাক্ত করার কাজ সহজ হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছে, যদি এই পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ না করা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে এবং নতুন করে বড় ধরনের নাশকতা ঘটে যেতে পারে।
এদিকে, স্থানীয় প্রশাসন এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলি এই পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা করছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় নিরাপত্তা আরও কড়াকড়ি করা হচ্ছে, যাতে হিজবুত তাহরীর এবং অন্যান্য নিষিদ্ধ সংগঠন তাদের কার্যক্রম চালাতে না পারে। এর পাশাপাশি, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে, যাতে তারা সন্দেহজনক কার্যকলাপ লক্ষ্য করলে তা প্রশাসনকে জানাতে পারে।
নিরাপত্তা বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে আশা করা হচ্ছে, হিজবুত তাহরীরের কার্যক্রম যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে। তবে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ, কারণ একদিকে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানে শাসনব্যবস্থার অস্থিরতা এবং অন্যদিকে সীমান্তবর্তী রাজ্যে সংযোগের মাধ্যমে জঙ্গি কার্যকলাপ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরও তৎপরতা এবং প্রশাসনের সজাগ নজরদারি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।