ভালোবাসার কাহিনি ‘বাকরখানি’

সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু এমন কিছু কিছু জিনিস থাকে, নিজ গুণে যারা থেকে যায় শতকের পর শতক। যেমন পিজা, বার্গার, প্যাটিসের জমানায়…

bakarkani-story

সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় অনেক কিছু। কিন্তু এমন কিছু কিছু জিনিস থাকে, নিজ গুণে যারা থেকে যায় শতকের পর শতক। যেমন পিজা, বার্গার, প্যাটিসের জমানায় আজও পুরনো ঢাকায় দাদাগিরি করছে। বাকরখানি। প্রায় তিনশো বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারক এই বাকরখানি ও কাপভর্তি চায়ে চুমুক দিয়ে ঘুম ভাঙে পুরনো ঢাকাবাসীর। এই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এখানকার মানুষের ভালোবাসা, আবেগ আর তার সঙ্গে করুণ এক প্রেমকাহিনি।

‘কিংবদন্তি ঢাকা’ বইটিতে লেখা আছে, মুঘল আমলে সুবেদার মুর্শিদকুলি খানের দত্তক পুত্র আগা বাকের ও তার প্রেমিকা খানির নাম থেকেই এই খাবারের নাম হয়েছে বাকরখানি।জনশ্রুতি, চট্টগ্রামের আগা বাকর এক সময় আরামবাগের সুন্দরী নর্তকী খানি বেগমের প্রেমে পড়েন। তাঁর প্রেমের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজির জাহান্দার খাঁর ছেলে কোতোয়াল জয়নুল খা। তবে জয়নুল খাঁ প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে খানি বেগমের কাছে গেলে, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন রাগে-অপমানে জয়নুল খাঁ খানি বেগমকে হত্যা করতে উদ্যতে হলে আগা বাকের বাধা হয়ে দাঁড়ান। প্রতিশোধ নিতে তখন জয়নুল তাঁর দুই সঙ্গীকে। ‘খানি বেগমের প্রেমে মত্ত হয়ে আগা জয়নুল খাঁ-কে হত্যা করেছে’ মিথ্যে কথা শিখিয়ে মুর্শিদকুলি খানের কাছে পাঠান। রেগে গিয়ে সুবেদার আগাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে আগাকে বাঘের খাঁচায় নিক্ষেপ করেছিলেন। তবে শক্তিধর কুশলী যোদ্ধা বাঘকে হত্যা করে খাঁচা থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে। আসেন। এদিকে উজির জাহান্দার খাঁ ও জয়নুল খাঁ খানি বেগমকে হরণ করে নিয়ে যান সাউথ বেঙ্গল। আগা বাকের প্রেমিকাকে উদ্ধার করতে রণসাজে সেখানে উপস্থিত হলে জয়নুল খাঁ খানি বেগমকে হত্যা করেন। ঠিক তখন

   

bakarkani-story

অসাবধানতাবশত জাহান্দার খাঁর হাতে নিহত হন জয়নুল। এরপর খানি বেগমের দেহ চন্দ্রদ্বীপে নিয়ে গিয়ে সমাধি দেন। তবে প্রিয়াকে প্রাণে বাঁচাতে না পেরে নিজের ও প্রিয়তমার নাম পরতে পরতে জড়িয়ে আগা বাকর খান প্রথম বাকরখানি তৈরি করে অমর করে দিয়ে গিয়েছিলেন বাকরখানির প্রেম।

তবে বাকরখানি নিয়ে নানা মুনির নানা মত রয়েছে, যেমন শাহজাহানের পাতেও নাকি রোজ পড়ত এই বাকরখানি। শাহজাহানের আমলে জাহাঙ্গির বাদশার ভায়রাভাই ছিলেন বাকর খান। সে সময় বাদশার দরবারে অত্যন্ত গুরুত্ব ছিল তাঁর। জীবনের বিভিন্ন সময়ে আগ্রা, মুলতান, অওধ, ওড়িশা, গুজরাট, এলাহাবাদের গভর্নর ছিলেন বাকর খান। এঁর নাম অনুসারে এই খাবারের নাম বাকরখানি। তবে কাহিনি যা-ই হোক না কেন, ফাস্টফুডের জমানায় বাদশাহি আমেজে পসরা সাজিয়ে বসে আছে এই বাকরখানি। কিন্তু এখন প্রশ্ন হল, কি এই বাকরখানি! রুটি। ঘি, দুধ, মাখন ও ডিম দিয়ে তৈরি হয় বিশেষ একপ্রকার রুটি।

তবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন নতুন স্বাদে বাজার ছেয়েছে বাকরখানি। কোনওটায় রয়েছে পনির তো কোনওটায় মাংস। আবার কোনওটায় নারকেলের স্বাদ। রয়েছে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য নোনতা বাকরখানিও। সাধারণত বাকরখানির দাম প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তবে চিনি মেশানো বাকরখানির দাম একটু বেশি। পুরনো ঢাকার বাগডাশা লেন, বেচারাম দেউড়ি, নাজিমুদ্দিন রোড, সিদ্দিকি বাজার, আলু বাজার ও বেগম বাজারের বাকরখানি খুবই প্রসিদ্ধ।

বাকরখানি রেসিপি

যা যা লাগবে:
ময়দা ১ কেজি, ঘি ২৫০ গ্রাম, গরুর দুধ ২৫০ গ্রাম, মুরগির ডিম ১টা, নুন স্বাদমতো।

কীভাবে রান্না করবেন

ময়দায় নুন মিশিয়ে নিন। একটু একটু করে কঁচা দুধ ঢালুন আর ময়দা মাখতে থাকুন। ছোটো লেচি কাটুন। গােল গােল করে পাচ দিন। যতক্ষণ ময়দার গায়ে বুড়বুড়ি ফুটে ওঠে। একটা কাপড় পেঁচিয়ে ঘণ্টাখানেক। রেখে দিন। কিছুক্ষণ পর হাতের তালুতে ঘি মাখিয়ে হাতে চেপে চেপে । পাঁচটা চাপাটি বানান। চাপাটিগুলাের নীচের পিঠে ঘি মাখান। তারপর আটা মাখার পাত্রের নীচে রেখে দিন। অল্প একটু পরেই পাত্রের ঢাকনা খুলে । দিন। একটা চাপাটি তাওয়ায় সেঁকে অর্ধেক রান্না হয়ে এলে, দুধ ও ডিমের সাদা অংশের গোলা বানিয়ে সেটা চাপাটির ওপর ছিটিয়ে দিন। রুটির মতো ফুলে উঠলে নামিয়ে নিন। (রেসিপিটি শাহজাহানের বাদশাহি হেঁশেলের রেসিপি সংকলন পরিচিত ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি’ থেকে নেওয়া