ক্ষমতার বৃত্তেও ‘নিঃসঙ্গ’ বুদ্ধদেবের ‘বিশ্বস্ত’ সঙ্গী ছিল সিগারেটই!

তিনি বঙ্গ রাজনীতির কার্যত মুকুটহীন সম্রাট। বলতে গেলে ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষ সেনাপতি তিনিই। ব্রিগেডের মাঠের বাম সমাবেশে না থেকেও সবার মুখে আজও ঘোরে…

Buddhdeb Bhattacharya

তিনি বঙ্গ রাজনীতির কার্যত মুকুটহীন সম্রাট। বলতে গেলে ৩৪ বছরের বাম শাসনের শেষ সেনাপতি তিনিই। ব্রিগেডের মাঠের বাম সমাবেশে না থেকেও সবার মুখে আজও ঘোরে তাঁরই কথা। বঙ্গ রাজনীতির রঙ্গমঞ্চের স্পটলাইটে না থেকেও আজও যেন সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক তাঁর নাম। তিনি পশ্চিমবঙ্গের সদ্যপ্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য (Buddhdeb Bhattacharya)।

বাম শাসনের শেষ পর্বে এসে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব কার্যত যাকে ট্র্যাজিক হিরোতে পরিণত করেছে। একটা সময় নিজের দলের পলিটব্যুরোই তাঁকে দোষী করে তাঁর পাশ থেকে সরে গিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেও শেষের দিকে একাকীত্ব আর অবসাদ তাঁকে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছিল।

   

দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিলেন, আর বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নিজের প্রিয় সিগারেটের প্রতি আসক্তি। ডাক্তার, পরিবার কারো কথাতেই কর্ণপাত করেননি ফুসফুসের সমস্যায় ভোগা বুদ্ধদেববাবু। এমনকী ২০০৮ সালে রাইটার্সে ধূমপান বন্ধ হওয়ার প্রস্তাবের পরেও সিগারেট না ছাড়ার বেপরোয়া ঘোষণা ছিল তাঁর ঠোঁটে।

প্রায় ৩০ বছর আগে ক্ষুব্ধ হতাশাগ্রস্ত বুদ্ধবাবুর কলম থেকে বেরিয়েছিল এক নাটকের চিত্রনাট্য। যার নাম ছিল ‘দুঃসময়’। তৎকালীন জ্যোতি বসু সরকারের বিরুদ্ধে ‘চোরেদের মন্ত্রিসভা’ স্লোগান তুলে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন বুদ্ধবাবু। পরবর্তীকালে সেই জ্যোতি বসুর ছেড়ে যাওয়া চেয়ারেই বসেন তিনি। তাঁর সময়ই রেকর্ড আসনে বামফ্রন্টের জয়। আবার ভাগ্যের পরিহাসে তাঁর শাসনেই অবসান বামফ্রন্ট সরকারের।

শোনা যায় শেষের দিকে তাঁর মনে সরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্তও উঁকিঝুঁকি মেরেছিল। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বের পর দিল্লির পলিটব্যুরো মিটিংয়ে প্রকাশ কারাট শিবির কার্যত তাঁকেই ভিলেন বানিয়ে ছিলেন। শোনা যায় সেই মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য! কারন সে সময় তিনি শিলিগুড়িতে কর্পোরেশনের ভোটের প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন। তবে সরকার বিরোধিতার হাওয়াতে সেই ভোটও হারতে হয়েছিল তাঁর দল অর্থাৎ সিপিআইএমকে। হয়ত তখনই তিনি আগামী দিনের দেওয়াল লিখন পড়তে পেরেছিলেন।

শোনা যায় সেই সময় শিলিগুড়িতে থাকাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধদেববাবু। দুদিনের সফরকে ‘এক্সটেন্ড’ করে পাঁচ দিন উত্তরবঙ্গে ছিলেন তিনি। কিন্তু সেটাকেই হাতিয়ার করে দলের মধ্যে তাঁর বিপক্ষ শিবির দিল্লিতে তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানায়। শোনা যায় উত্তরবঙ্গের মংপু বনবাংলোতে থাকাকালীন শারীরিক এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বুদ্ধদেববাবুর সঙ্গী ছিল গান আর সিগারেট। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গানের সঙ্গে সিগারেটই সেই সময় যেন তাঁর ছায়া সঙ্গী হয়ে উঠেছিল।

সেসময় সিঙ্গুরের টাটা কারখানা আইনি এবং রাজনৈতিক জটিলতায় বিদ্ধ। নন্দীগ্রামের ঘটনায় সরকার কার্যত ব্যাকফুটে। বৈদিক ভিলেজের দুর্নীতিতে প্রিয় আইটি হাবের স্বপ্নও ধ্বংসের মুখে। সব মিলিয়ে সে সময় চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী।

তার উপরে লোকসভা নির্বাচনে বিপর্যয়ের দায় দিল্লি চাপিয়ে দিয়েছে তাঁর কাধেই। যা কোনওভাবেই মন থেকে মেনে নিতে পারেননি বুদ্ধদেববাবু। তবে উত্তরবঙ্গে থাকাকালীন গাঢ় সখ্যতা জন্মায় দলের আরেক নেতা তথা তৎকালীন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের মন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ক্ষমতার বৃত্ত থেকে চলে যাবার পরেও যে বন্ধুত্ব অটুট ছিল বলে শোনা যায়।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই সময়কার এক ঘনিষ্ঠের মুখে শোনা যায় তাঁর সাহিত্য প্রীতির কথা। এক সময় রাশিয়ান লেখক এবং নাট্যকার ভ্লাদিমির মেয়কোভস্কির বেশ কিছু কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন বুদ্ধদেব বাবু। একাকীত্ব কাটাতে সেগুলোকে নিয়েই আবার নাড়াচাড়া শুরু করেন। শুরু করেন পাকিস্তানি ইরানিয়ান এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কিছু পুরস্কার জয়ী সাহিত্যিকদের লেখা পড়াও।

সেই সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু নাটক নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেছিলেন। অনেকে মনে করছিলেন হয়ত নিজের লেখা ‘দুঃসময়’-এর দ্বিতীয় পর্ব লেখার তোড়জোড় শুরু করেছেন লেখক বুদ্ধদেব। দলের একের পর এক ভুল সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে কার্যত ক্রীড়ানক হয়েছেন বুদ্ধদেব এমনটাই বলেন অনেক রাজনীতিবিদ।

মুখে কিছু না বললেও তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মনে মনে সেটা কখনোই মেনে নিতে পারেনি বলেই মনে করা হয়। আর তাই তাঁর নিজের অবসাদ, রাগ, ক্ষোভকে এভাবেই নিজের মধ্যে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। সিঙ্গুরের কারখানা না হওয়ার হাহাকার বারবার শোনা গিয়েছে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেবের গলায়।

ঘনিষ্ঠ মহলে স্বীকার করেছেন নিজের ক্ষমতা চলে যাওয়াতে যত না দুঃখিত, তার থেকেও শতগুণ বেশি দুঃখ রয়েছে সিঙ্গুরে টাটাদের কারখানা কিংবা নিউটাউনের আইটি হাব না হওয়ার জন্য।

প্রত্যক্ষ রাজনীতির আঙিনা থেকে কার্যতো অবসর নিয়েছেন বহুদিন আগেই। তবুও প্রাণের টানে এবং সমর্থকদের ভালোবাসার কারণে ব্রিগেডের মাঠে দেখা গিয়েছে বুদ্ধকে বারবার। ফুসফুসের গভীর সমস্যায় ভোগা অসুস্থ বুদ্ধবাবু ব্রিগেডে ধুলোর কারণে নিজের গাড়ি থেকেও নামতে পারেননি।

কিন্তু তবুও গাড়ি নিয়ে মাঠে হাজির হয়েছিলেন তিনি। তিনি আসবেন জেনে যেন ব্রিগেডের বাম জনতার উচ্ছ্বাস দ্বিগুণ হয়ে যেত বারবার। এমনকী বঙ্গ রাজনীতির বর্তমান শাসক তথা তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল তৃণমূলের একাধিক কর্মী সমর্থকও ব্যক্তি বুদ্ধদেবকে আজও শ্রদ্ধাই করেন।

২০২৪-এ দাঁড়িয়েও ডিওয়াইএফআই-এর ব্রিগেড এর আগেও বামফ্রন্টের মীনাক্ষী তাই ছুটে গিয়েছিলেন পাম এভিনিউয়ের দুই কামরা ফ্ল্যাটে। অসুস্থ অশিতিপর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আশীর্বাদ এবং বার্তা নিতে। আজও যেন সেলিম, সুজন, সৃজন, দিপ্সিতা মীনাক্ষীদের মধ্যেও বামফ্রন্টের পোস্টারবয় ৮০ বছরের চিরতরুণ সেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যই।

বঙ্গ রাজনীতিতে এই মুহূর্তে ‘দেব’ আছেন। হয়তো আগামী দিনে কোনও এক বুদ্ধেরও দেখা মিলতেই পারে। কিন্তু ‘বুদ্ধদেব’ ভট্টাচার্যের মতো চরিত্র শুধু বাংলা কেন ভারতীয় রাজনীতিতেও আর আসবেন কিনা, যথেষ্ট সন্দেহ আছে।