এতকাল জীবনটা কাটিল উপগ্রহের মত। যাহাকে কেন্দ্র করিয়া ঘুরি, না পাইলাম তাহার কাছে আসিবার অধিকার, না পাইলাম দুরে যাইবার অনুমতি।
__ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
হলো তো অন্যের জন্য বাঁচা! ঠিক আর কতদিন, কত ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ড পর বুঝবেন যে এবার আপনার “অবলম্বন” আপনাকেই হয়ে উঠতে হবে? এতকাল ধরে নিজের বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী /স্ত্রী, ছেলে মেয়ে, শ্বশুর বাড়ি,বন্ধুবান্ধব সবাইকে আগলানোর দ্বায়িত্ব আপনি নিয়েছেন।
এতকাল আপনি সকলের বট গাছের ছায়া হয়ে ছিলেন। কিন্তু আপনার মাথার ওপরটা যে এতকাল তাপ, বিদ্যুৎ, ঝড়, জল সহ্য করল, নিজে কী পেলেন একবার সেই হিসাবটা কসেছেন? ভেবে দেখেছেন, আপনারও বাকিদের মতো একই রকম যত্ন, ভালোবাসা, পছন্দের জিনিসকে আঁকড়ে ধরার ইচ্ছে বা অধিকার আছে কিনা? শখ গুলোকে তো গলা টিপে হত্যা করেছেন…এখন গালে হাত দিয়ে হাউতাস না করে; এখনও সময় আছে শুরু করুন।
প্রতিদিনের কিছু ইতিবাচক অভ্যাস গড়ে তুলুন আর রোজ প্রতি মুহূর্তে নিজেকে বলা শুরু করুন “আমি পরিবর্তিত হচ্ছি। আমি নিজেকে ভালোবাসায় মগ্ন হচ্ছি। জীবনের শান্তির নির্যাস গ্রহণ করছি।” —- এটাই আপনাকে কয়েকদিনেই করে তুলবে অতুলনীয়:
(১) নিজের প্লাস পয়েন্টকে চিনতে শিখুন। আপনি কী কী কাজ পারেন, কোন বিষয়ে আপনার আগ্রহ রয়েছে আর কোথায় বা কোন বিষয় আপনার খামতি, জড়তা আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করুন।
(২) এরপর আত্মবিশ্বাসকে কাজে লাগান। কোনও মানুষই পারফেশনিস্ট হয়ে জন্ম নেয় না। প্রতিভা ভিতরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। কোনও গুণ নেই, কিছু পারেন না — এমনটা হতেই পারে না। ঘুমিয়ে থাকা প্লাস পয়েন্ট বা লুকিয়ে রাখা ইচ্ছাকে এবার সামনে আনুন, ডানা মেলে উড়তে দিন। এর জন্য ঠিক যা যা করণীয় সেগুলো করা শুরু করে দিন।
(৩) আগে কী হয়েছে, আজ তা ভেবে লাভ নেই। তবে বর্তমানে ইন্টারনেটের দুনিয়াতে যাবতীয় তথ্য এখন মুহূর্তে হাতের মুঠোয়। এই মাধ্যমটিকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করুন।
(৪) রোজ সকালে উঠে একটা প্ল্যান তৈরি করতে হবে। শুরুটা ছোট ছোট পদক্ষেপ দিয়েই হোক। ক্ষতি কি!!!অন্তত আপনার ইচ্ছা বা ভালো লাগার কাজগুলো শুরু তো হল।
(৫) তৈরি করা প্ল্যান অনুযায়ী রোজকার দিনটা কাটানোর চেষ্টা করুন। নিজেকে নিয়ে ভাববেন বা নিজেকে ভালোবাসবেন মানে এটা নয় যে আপনি পরিবার বা এতদিন যা যা দ্বায়িত্ব বা কাজ করে এসেছেন তার সবটাই বাদ দিয়ে দেবেন। এমনটা একেবারেই করবেন না। নিজেকে ভালোবাসা স্বার্থপরতা নয়। আবার নিজের দিকে তাকাতে গিয়ে বাকিদের বাদ দিয়ে দেওয়াও ঠিক নয়। যতটা আপনার পক্ষে করা সম্ভব ততটাই করুন। এতদিন যে নিজেকে একটা মেশিনের মতো করে রেখেছিলেন, এবার এই অপ্রাসঙ্গিক অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসুন।
(৬) আপনাকে বুঝতে হবে যে, আপনি কোনো মানচিত্র নন যে সমস্ত জগত আপনার ওপর দাঁড়িয়ে থাকবে।
(৬) মানসিকতায় পরিবর্তন আনুন। সঞ্চয় অবশ্যই জরুরি একটা অভ্যাস। তবে দোকানে, বাজারে গিয়ে দু পয়সা নিয়ে দির কষাকষির দরকার নেই। দু/ চার পয়সা বেশী খরচ হলে আমি দরিদ্র আপনি দরিদ্র হবেন না। বরং যে লোকটি দু পয়সা বেশী রোজগারের আশায় মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে সে দু পয়সা বেশী পেলে হয়ত তার মেয়েটির লেখাপড়ার খরচ, পরিবারের মানুষের ওষুধ জোগাতে সাহায্য হবে। নিজের মধ্যে ভেতর থেকে বদল আনতে হবে।
(৭) বয়স্ক লোকদের বলা একই গল্প বারবার শুনেও তাদের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ না করে তাদের কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন। তাদের সঙ্গী হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। তাদের এই একাকিত্ব ঘোচানোর আনন্দে সামিল হয়ে আপনিও একটু হাসুন। এই গল্পগুলোর মধ্যে তাদের অতীতের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে, যা তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে কিছুটা আনন্দ বয়ে আনে।
(৮) লোকের ভুল ত্রুটি দেখে তাকে শুধরে দেবার জন্য প্রাণপণ লড়াই করার কোনও দরকার নেই। সারা পৃথিবীর মানুষকে শোধরানোর দায় আপনার নয়।
(৮) কেউ অবজ্ঞা করলে অপমানিত হয়ে রেগে যাবেন না। বরং তাদের তাদের থেকে দূরে সরে যান। সক্রেটিস একটি কথা বলেছিলেন, “জানতে হবে কোথায় চুপ করতে হবে। বুঝতে হবে কোথা থেকে সরে যেতে হবে।” সুতরাং, নিজের কাছে সৎ থাকুন, নিজেকে চিনুন, জানুন।
(৯) ইগোকে আঁকড়ে ধরে না থেকে যদি একটা ক্ষমা অনেকগুলো সমস্যার সমাধান করে, যদি নিজে থেকে কথা বললে একটু শান্তিতে থাকা যায়; তাহলে তাই করুন। তবে বারবার নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইগো মানুষকে একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়। বরং এটি ছেড়ে দিলে সম্পর্কগুলো সুন্দর হয়ে ওঠে।