Rabi Ghosh: বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন বাবা, ফিরে আসেন অভিনেতা হয়ে

বিশেষ প্রতিবেদন, কলকাতা: স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল।…

Special report about actor Ravi Ghosh

বিশেষ প্রতিবেদন, কলকাতা: স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নাটকে অভিনয়ের হাতেখড়ি। তারপর যখন কলেজে ভর্তি হলেন তখন বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘বন্ধুমন’ নামে একটি নাটকের দল। মহড়া দিতেন আশুতোষ কলেজের ছাদে। কিন্তু, বাবা জীতেন্দ্রনাথ তা একেবারেই পছন্দ করতেন না। প্রায়ই স্ত্রী জ্যোৎস্না রানীকে বলতেন, “ অভিনয় কইরা সময় নষ্ট করে ক্যান ? তোমার পোলারে কয়া দিও ওই চেহারায় অভিনয় হয় না। সে ছিলো দুর্গাদাস বাঁড়ুজ্যে, হিরোর মতন চেহারা।”

অভিনয়ের এমনই পোকা ছিলেন যে বাড়ি থেকে তাকে বের পর্যন্ত করে দেওয়া হয়েছিলো। তবে মায়ের সমর্থন ছিলো পুরোপুরি। তাই তিনি সামনে এগুতে পেরেছিলেন। ভাগ্যিস মা-র সমর্থন ছিলো নইলে বাংলা চলচ্চিত্র এতো শক্তিশালী চরিত্র – অভিনেতা পেতো না। মহড়া সেরে গভীর রাতে বাড়ি ফিরতেন , চুপি চুপি , যাতে বাবা টের না পান । জীবনের কী সমাপতন ! মঞ্চে অভিনয়ের ঠিক পাঁচদিন আগে বাবা চলে গেলেন । মায়ের কাছে বললেন ছেলে‚ তাঁর দলের অনেক দেনা-কর্জ । শো বাতিল হলে মুশকিল । কালাশৌচের মধ্যেই প্রথম মঞ্চাবির্ভাব । অভিনয়ের প্রতি এই নিখাদ নিবেদন বজায় ছিল জীবনের শেষদিন অবধি । তখন তিনি প্রতিষ্ঠিত । আচমকা মৃত্যু ছোট বোন তপতীর । তার কয়েক ঘণ্টা পরে মঞ্চে বেদম হাসির নাটক ” কনে বিভ্রাট ” দেখে কেউ আঁচও করতে পারেনি সদ্য বোনকে হারানো রবি ঘোষের মনের মধ্যে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে — সে যেন ছিল নিজের সঙ্গে নিজের প্রতি হাস্যকর অভিনয় ! তিনি অভিনেতা নয়, কমেডিয়ান নয় বরং চরিত্রাভিনেতা হিসেবে নিজেকে সব সময় পরিচয় দিতেন। বলতেন যেকোনো চরিত্রই ফুটিয়ে তোলা একজন চরিত্রাভিনেতার কাজ।

   

রবি ঘোষ তাঁর অভিনয়ের গুরু বলে মানতেন চার্লি চ্যাপলিনকে। যে চ্যাপলিন বলেছিলেন, “Actors search for rejection. If they don’t get it they reject themselves.” এখন আর কমেডিয়ানদের যুগ নেই। সারা বছরে হয়তো গুটিকয়েক কমেডি ছবি মুক্তি পায়। একটিও বক্স-অফিস সাফল্য নয়। অনেকবছর আগে অনীক দত্তের ‘ ভূতের ভবিষ্যৎ ’ রমরমিয়ে চলেছিল বটে। তাও হাতেগুনে ওই একটিই। এখনকার কমেডি বাংলা ছবি জোর করে কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসায়। কিন্তু রবি ঘোষকে কেউ ভোলেনি। ‘দ্য রিয়্যাল হিরো’ – কে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। শুধু বডি – বডি করে না কাটিয়ে পড়াশোনাও করেছেন নিজের মতো। তাঁর পড়াশোনা, বিশ্বের বিভিন্ন ছবি দেখা কত সমৃদ্ধ, সবকিছুই বোঝা যাবে রবি ঘোষের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনলে বা পড়লে । ভাগ্যিস তিনি অভিনয়ে এলেন ! নাহলে এই ক্ষুদ্র জীবন নতুন দর্শনের ভ্রমণে ঘুরতে পারতেন না।

Special report about actor Ravi Ghosh

বিশ্বখ্যাত পরিচালক – অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, “ To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.” তারপর আরও বলেছিলেন, “ Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot.” — এই অমোঘ সমস্ত কথাগুলির সঙ্গে দৃশ্যত মানিয়ে যায় আমাদের প্রত্যেকের পছন্দের এক অভিনেতার নাম — তিনি হলেন রবি ঘোষ ! পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষদস্তিদার । আক্ষরিক ও ব্যবহারিক দু দিক দিয়েই মধ্যবিত্ত বাঙালির পক্ষে খুব ভারী নাম । সংক্ষেপ করে নিয়েছিলেন । বাদ পড়েছিল ইন্দ্র‚ নাথ ও দস্তিদার । যেটুকু ছিল সেটুকু ছোট‚ উচ্চারণেও সুবিধে — ছোট হলেও সে নামের ওজন ও অভিঘাত দুইই বড় সাঙ্ঘাতিক । কয়েক দশক ধরে বাংলা ছবিতে সে নামের ‘ কী দাপট ‘ ! জন্ম পূর্ববঙ্গে ১৯৩১-এর ২৪ নভেম্বর ! আজ সেই উপলক্ষে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলী !

আপাদমস্তক দক্ষিণ কলকাতার মহিম হালদার স্ট্রিটের বাসিন্দা । পড়তেন ভবানীপুরের সাউথ সাবার্বান স্কুলে । তারপর আশুতোষ কলেজ । বিজ্ঞান শাখায় পড়ছেন । বাবার আশা‚ ভবিষ্যতে ভদ্রস্থ চাকরি বাঁধা । কিন্তু ছেলেও মন বন্ধক দিয়ে দিয়েছেন থিয়েটারের কাছে । সেই সময় মাস্‌ল ফুলিয়ে, ছাতি চওড়া করে সিনেমায় ‘হিরো’ হওয়ার চল ছিল না। সুন্দর মুখ আর শক্তিশালী অভিনয়েই প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজের জাত চেনাতেন। তিনি একলব্য হলে তাঁর দ্রোণাচার্য উৎপল দত্ত । কলেজে পড়তে পড়তে শরীরচর্চা করতেন । পাখির চোখ — মঞ্চে অভিনয় ।

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ১৯৫৯ সালে তার ‘আহ্বান’ চলচ্চিত্রে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রবিকে যুক্ত করেন। কিন্তু, রবির জীবনের মোড় ঘুরে যায় তপন সিনহার ‘গল্প হলেও সত্যি’- তে অভিনয়ের পর। ছবিতে এক চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করলেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন মূল চরিত্র। তপন সিনহার ‘ গল্প হলেও সত্যি ‘ – তে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি সবার নজরে আসেন। যদিও পূর্বেই মঞ্চে উৎপল দত্তের ‘অঙ্গার’ নাটকে তাঁর অনবদ্য অভিনয় দেখেছিলেন পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এবং বড় পর্দায় প্রথম সুযোগ দেন তিনি — ১৯৫৯ সালে ‘ আহ্বান ‘ ছবি । নায়ক অনিল চট্টোপাধ্যায়‚ নায়িকা সন্ধ্যা রায়‚ সঙ্গে নবাগত রবি ঘোষ । ১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায় নির্মিত ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চরিত্রে তার অভিনয় চলচ্চিত্রজগতে একটি মাইলফলক। বাঘা চরিত্রে অভিনয় করে অভিনয় শিল্পটিকেই এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি।

‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিগুলিতে একের পর চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়ে ছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবি ঘোষ। নায়কোচিত চেহারা না হলেও সে যুগের বাংলা ছবির সমস্ত পরিচালকের প্রিয়পাত্র ছিলেন রবি। তাঁর হাত ধরেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কত কত সফল অভিনেতা ও অভিনেত্রী এসেছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে ! ১৯৫৩ সালে কলকাতা ব্যাঙ্কশাল কোর্টে চাকরি শুরু করলেও ১৯৬১-তে সেই পাট চুকিয়ে পাকাপাকি ভাবে অভিনয়কেই পেশা হিসেবে বেছে নেন রবি ঘোষ। অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হতেন যে যখনই কোনো নতুন মুখের দরকার পড়েছে তখনই এগিয়ে এসেছেন। ‘আকাশ কুসুম’-এর জন্য মৃণাল সেনের কাছে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়কে, ‘মহানগর’এর জন্য জয়া ভাদুড়িকে, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’- র জন্য সত্যজিত রায়ের কাছে শমিত ভঞ্জ ও শুভেন্দুকে নিয়ে গিয়েছেন।

সিনেমা দেখেন কিন্তু রবি ঘোষকে পছন্দ করেন না – এমন তো হতেই পারে না। ‘ বাঘা বাইন ’ আসলে রবি ঘোষ বরিশালের বাঙাল , যদিও বড় হয়েছেন কলকাতায়। জীবনের বড় অংশ জুড়েই আছে তাঁর সিনেমার গুরু সত্যজিৎ রায়, নাটকের গুরু উৎপল দত্ত ও কমলকুমার মজুমদার। চকলেটের লোভ দেখিয়ে জয়া ভাদুরিকে নায়িকা হতে রাজি করিয়েছিলেন রবি ঘোষ। বিভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তিনি সবচেয়ে পরিচিত তার হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন। রবি ঘোষের অভিনয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা। অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা তাঁর প্রতিটি চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করেছিল। আজীবন বাংলা ছবির ‘কমেডিয়ান’ তকমা পেলেও তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চরিত্র অভিনেতা !

অথচ পর্দায় যতই তিনি একজন কমেডিয়ান অভিনেতা হোন না কেন, বাস্তবে ব্যক্তি হিসেবে ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত। যিনি সময় পেলেই ‘রামকৃষ্ণ কথামৃত’ পড়তেন। পরচর্চা পরনিন্দা একবারে না-পসন্দ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সাঙ্ঘাতিক সিরিয়াস । প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী অনুভা গুপ্ত প্রয়াত হয়েছিলেন ১৯৭২-এ । তার ১০ বছর পরে বিয়ে বৈশাখী দেবীকে । এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম আলাপ । প্রথম দর্শনে বৈশাখী দেবী নাকি খুব হেসেছিলেন তাঁকে দেখে । পরে নিজেই এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন বৈশাখী দেবী । আলাপের মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বিয়ে । যখনই মজার সংলাপ শোনার আব্দার করতেন উল্টোদিক থেকে জবাব আসতো — কেন ! আমি কি জোকার ?

বাইরের কেউ না থাকলে কাজের লোকেদের, ড্রাইভার গণেশকে বসিয়ে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ শোনাতেন। যে জন্য বহুবার বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত তাতেই নিবিষ্ট করেছিলেন, তার নাম ‘অভিনয়’। বরিশালের এ হেন কুলীন বাবুটি হলেন রবি ঘোষ।

পাঁচের দশকে (১৯৫০-’৫১) ‘সাংবাদিক’ নাটক দিয়ে পথ চলা শুরু। উৎপল দত্তের পরিচালনায় এই নাটকে মাত্র তিরিশ সেকেন্ডের অভিনয় দেখে সে দিন মৃণাল সেন বুঝেছিলেন রবি ঘোষ কত বড় অভিনেতা। সাউথ সাবারবান মেন স্কুল – এ পড়াকালীন নাটকের মহড়া দিতেন বন্ধুদের ছাদে। সহপাঠী অভিনেতা তরুণ চট্টোপাধ্যায় সঙ্গে থাকতেন। ভবানীপুর আশুতোষ কলেজের নৈশ বিভাগে বি কম- পড়ার পাশাপাশি নিয়মিত শরীরচর্চায় মন দেন। কলেজই বন্ধুত্ব হয় সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এঁরই পরামর্শে পৌঁছে যান উৎপল দত্তের নাটকের দল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপে’। ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ — উৎপল দত্তের পরিচালনায় মিনার্ভা থিয়েটারে লিটল থিয়েটার গ্রুপ নিবেদিত ‘অঙ্গার’ নাটকের প্রথম শো।

সেদিন থেকে শেষ শো পর্যন্ত অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই নাটকের জন্য ‘উল্টোরথ’ পুরস্কার পান। নাছোড় অভিনেতা-পুত্রের অভিনয় দেখার দিন ঠিক করেছিলেন শেষ পর্যন্ত বাবা জীতেন্দ্রনাথ। কিন্তু বিখ্যাত ‘অঙ্গার’ নাটকে ছেলের অভিনয় আর দেখা হয়নি। ২৫ ডিসেম্বর মারা যান তিনি। ‘অঙ্গার’ নাটকে সনাতনের ভূমিকায় একজন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ খনি থেকে উঠে উচ্চ স্বরে বলে উঠেছিলেন ‘ আমি একজন ভূতপূর্ব লোক ’ ‑ যাঁরা সেই কন্ঠস্বর শুনেছিলেন তাঁরা আজীবন ভুলতে পারেননি।

ওঁর জীবনের অন্যতম প্রেরণা ছিলেন স্ত্রী অনুভাদেবী। অনুভা যখন একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেত্রী, তখন রবি ঘোষ একজন স্ট্রাগলিং অভিনেতা। অথচ কী সুন্দর ভাবে একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ‘অঙ্গার’ নাটকের অভিনয় দেখে পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ‘কিছুক্ষণ’ ও তপন সিংহ ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র জন্য ডাকেন। আর থেমে থাকতে হয়নি। তপন সিংহ তো রবিকে শুধু কমেডিয়ান হিসাবে দেখতেন না, দেখতেন চরিত্রাভিনেতা হিসাবে। তাঁর কথায়, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। ” ‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’র পরেই প্রস্তাব আসে সত্যজিত রায়ের ‘অভিযান’-এর জন্য।

‘হাঁসুলিবাঁকের উপকথা’ ছবি করার সময় থেকে অনুভাদেবীর সঙ্গে সম্পর্কের শুরু। সেই সময় রবি ঘোষ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে অনুভাদেবীর সেবায় সুস্থ হয়ে ওঠেন। নানা টানাপোড়েনের মধ্যে বিয়ে করলেও ১৯৭২-এ স্ত্রীর অকাল মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন রবি ঘোষ। প্রায় বছর দেড়েক অভিনয় জগত থেকে সরে ছিলেন। ফিরে আসেন ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’- এর মাধ্যমে। এর এক দশক পরে, ১৯৮২-তে বৈশাখীদেবীকে বিয়ে করেন। ৪৭ নম্বর মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন গলফ গ্রিনের ফ্ল্যাটে।

সময়ের ব্যাপারে খুব পাংচুয়াল ছিলেন রবি ঘোষ। ‘ঠগিনী’ শ্যুটিং-এ একদিন নির্দিষ্ট সময় পার করে ফ্লোরে এলেন। লাঞ্চের সময় জানালেন, মাকে দাহ করে এলেন, তাই দেরি। কর্তব্যপরায়ণ, দিলখোলা, আড্ডাবাজ, খাদ্যরসিক, বহুমুখী প্রতিভাধর অভিনেতা ছিলেন রবি ঘোষ। শুধু তা-ই নয়, রবি ঘোষ ছিলেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ। এখানে তাঁর সম্পর্কে তাপস সেনের মূল্যায়নটি মনে রাখার মতো। তাঁর কথায়, “ বহু মানুষের নানা সমস্যায় রবি যে সাহায্য করেছিল তা তাদের সূত্রেই জানতে পারি। শুধু বড় শিল্পী নয়, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মানুষ। ” লোকে বলতো, ‘রবি ঘোষ মানেই একাই একশো’। পরিচালক তপন সিংহ তাই বলেছিলেন, “গোটা ভারতবর্ষে রবির মতো অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন চরিত্রাভিনেতা বাস্তবিক খুঁজে পাওয়া কঠিন। রবি ঘোষকে আমি সেই অর্থে কখনও কমেডিয়ান হিসেবে দেখিনি।” ” ওই চেহারার চোখদুটোই কথা বলে ! ” যেমনটি বলেছিলেন সত্যজিৎ রায়।

রবির অভিনয় সম্পর্কে একটা খাঁটি কথা বলেছিলেন উত্তমকুমার : “ আমরা হয়তো জাঁকিয়ে কিছু করার চেষ্টা করছি, আর রবি হয়তো কয়েক সেকেন্ড থেকে এমন একটা কিছু করবে যে ও গোটা দৃশ্যটা টেনে নিয়ে বেরিয়ে যাবে, লোকে হেসে গড়িয়ে পড়বে ”। আর বলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন,“ সব অভিনেতা, সব শিল্পী সব সময় আমার কাছে একশোয় একশো পায় না। রবি পেয়েছিল। ”

ওপরের দুটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি একে একে তিনি সত্যজিৎ রায়ের অভিযান (১৯৬২), মহাপুরুষ (১৯৬৫), অরণ্যের দিনরাত্রি (১৯৭০), হীরক রাজার দেশে (১৯৮০), গুপী বাঘা ফিরে এলো (১৯৯১), আগন্তুক (১৯৯১) প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। তিনি ‘নিধিরাম সর্দার’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালে তিনি ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত বার্লিন ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও অংশ নেন। গৌতম ঘোষ পরিচালিত বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘পদ্মা নদীর মাঝি’-তেও অভিনয় করেন রবি ঘোষ।
এসবের বাইরে রবি ঘোষ অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে ‘বসন্ত বিলাপ’(১৯৭৩), ‘পদি পিসির বার্মি বাক্স’ (১৯৭২), ‘ধন্যি মেয়ে’ (১৯৭১), ‘বালিকা বধূ’ (১৯৬৭), ‘কাল তুমি আলেয়া’(১৯৬৬),
‘স্বপ্ন নিয়ে’(১৯৬৬), ‘মোমের আলো’ (১৯৬৪), হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৬২) প্রভৃতি।
প্রায় অর্ধশত বছরের অভিনয় জীবনে তিনি প্রায় একশর মতো ছবিতে কাজ করেছেন।

‘অভিযান’-এ ট্যাক্সি ক্লিনার, ‘জন অরণ্য’- এ ‘মিস্টার মিত্র’, ‘গল্প হলেও সত্যি’- তে ধনঞ্জয়, ‘পদ্মা। কলম ধরেছিলেন রবি। লিখেছিলেন দশটি কৌতুক নকশা। ১৯৯৭-এর বইমেলায় প্রকাশিত হল তাঁর ‘হাসতে যাদের মানা’। বইমেলার ইতিহাসে স্মরণীয় ১৯৯৭। সে বছরই বিধ্বংসী আগুনে মেলা পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তিনদিনের মাথায় ফের শুরু হয়েছিল মেলা। কিন্তু সেই বইমেলা বাঙালির জীবনে আরও একটি বিষাদময় ঘটনার জন্য স্মরণীয়। তাঁর বই প্রকাশিত হল, আর তিনিও চলে গেলেন। মেলা চলাকালীনই ৪ ফেব্রুয়ারি হঠাৎই প্রয়াত হলেন রবি ঘোষ। তাঁকে হারিয়ে তাঁর সঙ্গী ‘গুপী গাইন’ তপেন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, “ শনিবার জুটি ছিলাম, রবিবার একা হয়ে গেলাম। ”