ভারত-পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে ধূমপানে এগিয়ে বাংলাদেশ

আজকের দিনে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তথ্যের আলোকে ধূমপান ও তামাক সেবনের বিষয়ে আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশ একটি উদ্বেগজনক স্থানে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী,…

WHO Global Health: Bangladesh Surpasses India, Pakistan in Tobacco Use

আজকের দিনে যখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) তথ্যের আলোকে ধূমপান ও তামাক সেবনের বিষয়ে আলোচনা চলছে, তখন বাংলাদেশ একটি উদ্বেগজনক স্থানে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রাপ্ত WHO গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরি (GHO) তথ্যে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে বয়স্কদের মধ্যে ধূমপান বা তামাক ব্যবহারের হার ৩২.৯% রেকর্ড করা গেছে, যা ভারত (২৪.৩%) এবং পাকিস্তান (১৮.৯%)-এর তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। এই তথ্য প্রকাশের পর থেকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এবং নীতি নির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন, কারণ এটি শুধুমাত্র একটি স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয় নয়, বরং অর্থনৈতিক ও সমাজীয় সমস্যার দিকেও ইঙ্গিত দেয়।

তথ্যের পটভূমি
WHO-এর ২০২৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে ধূমপানহীন তামাক (SLT) ব্যবহারের হার ২০.৬% এবং মোট তামাক ব্যবহারকারীর মধ্যে ৫৮.৪% ব্যক্তি এই ধরনের তামাক ব্যবহার করেন। এই হার ভারতের ২১.৪% এবং পাকিস্তানের ৭.৭% এর তুলনায় অনেক বেশি। উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে মহিলাদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার পুরুষদের তুলনায় বেশি (২৪.৮% বনাম ১৬.২%), যা এই অঞ্চলে একটি অস্বাভাবিক প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর পাশাপাশি, গ্রামীণ এলাকায় তামাক ব্যবহারের হার শহরের তুলনায় বেশি, যা অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত।

   

স্বাস্থ্য ঝুঁকি ও অর্থনৈতিক বোঝা
ধূমপান ও তামাক সেবনের ফলে মুখের ক্যানসার, হৃদরোগ এবং শ্বাসক্রিয়া সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর তামাকজনিত রোগের কারণে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, এবং এর অর্থনৈতিক বোঝা প্রায় ১০০০ কোটি টাকার মতো হতে পারে, যা স্বাস্থ্যসেবা খরচ এবং উৎপাদনশীলতা হ্রাসের ফলে সৃষ্ট হচ্ছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি অপরিবর্তিত থাকলে ভবিষ্যতে এই বোঝা আরও বাড়তে পারে। এই পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থা বেশি উদ্বেগজনক, কারণ এই দুই দেশে তামাক নিয়ন্ত্রণে কিছুটা উন্নতি ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে গ্রাফিক হেলথ ওয়ার্নিং এবং ডিজিটাল বিজ্ঞাপন নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে ধূমপান হার স্থির রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।

নীতিগত উদ্যোগ ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে প্রণীত “স্মোকিং অ্যান্ড টোব্যাকো প্রোডাক্টস ইউজেজ (কন্ট্রোল) অ্যাক্ট” এবং ২০১৩ সালে এর সংশোধনী আইন তামাক নিয়ন্ত্রণে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এই আইনে ধূমপানমুক্ত এলাকা ঘোষণা, তামাকের বিজ্ঞাপন নিষিধ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে তামাক বিক্রয় নিষেধ করা হয়েছে। তবে, সিঙ্গল সিগারেট বা ছোট প্যাকেট বিক্রয় নিয়ে কোনো সীমাবদ্ধতা না থাকা এবং ইন্টারনেটে তামাক বিক্রয়ের অনুপস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে।

Advertisements

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে তামাক শিল্পের প্রভাব এবং নীতি প্রয়োগে দুর্বলতা এই সমস্যাকে জটিল করছে। তামাক শিল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অঞ্চলে কৃষকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সস্তা তামাক পণ্যের প্রচার এই হার বাড়ার একটি প্রধান কারণ। এর ফলে সরকারকে আরও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যেমন তামাকের দাম বৃদ্ধি এবং জনচেতনা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা।

ভবিষ্যৎ উদ্দেশ্য
বাংলাদেশ সরকারকে WHO-এর ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল (FCTC) এর নির্দেশনা অনুসরণ করে তামাক নিয়ন্ত্রণে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতের মতো গ্রাফিক ওয়ার্নিং এবং পাকিস্তানের কিছু সফল স্থানীয় উদ্যোগ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব। তাছাড়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক বিরোধী শিক্ষা প্রবর্তন এবং গ্রামীণ অঞ্চলে স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাক ব্যবহারের হার ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া একটি গুরুতর সতর্কবার্তা। এই সমস্যা সমাধানে সরকার, স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং সমাজের সহযোগিতা অপরিহার্য। যদি সময়মতো পদক্ষেপ না নেওয়া যায়, তবে এটি ভবিষ্যতে একটি মহামারী হিসেবে রূপ নিতে পারে, যা বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে। তাই, আজ থেকেই শুরু করা প্রয়োজন—একটি তামাকমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য।