সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এক ইনফোগ্রাফিক নতুন করে শোরগোল তুলেছে দক্ষিণ (Viral beggar population)এশিয়া থেকে ইউরোপ–আমেরিকা পর্যন্ত। ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছে বিশ্বের ভিক্ষুক সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান, যেখানে নাকি প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত।
তালিকার প্রথম দশে রয়েছে নাইজেরিয়া, সিরিয়া, কঙ্গো, বাংলাদেশ, মিশর, সুদান, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং ব্রাজিলও। বিস্ময়ের বিষয়, এই বিতর্কিত তালিকায় ভারতের নাম নেই। যদিও সরকারি বা আন্তর্জাতিক কোনও স্বীকৃত সংস্থা এমন তালিকা প্রকাশ করেনি, তথাপি X–এ ভাইরাল হওয়া গ্রাফিক ঘিরে নানা রাজনৈতিক ও সামাজিক তর্ক শুরু হয়েছে।
হুমায়ুনের ‘বাবরি-স্বপ্ন’ কখনও সফল হবে না! বিস্ফোরক বৌদ্ধ সংঘের সভাপতি
প্রচলিত পোস্ট অনুযায়ী বিশ্বের সর্বাধিক ভিক্ষুকসংখ্যার দেশগুলির আনুমানিক চিত্র হল পাকিস্তান — ৮ মিলিয়ন, নাইজেরিয়া ৭ মিলিয়ন,সিরিয়া ৬.৭ মিলিয়ন, ডিআর কঙ্গো ৫.৩ মিলিয়ন, বাংলাদেশ ২০–৫০ লক্ষ, মিশর ৩০ লক্ষ, সুদান — ৪–১০ লক্ষ, যুক্তরাষ্ট্র ৬.৫ লক্ষ, ফ্রান্স ৩–৩.৩ লক্ষ, ব্রাজিল ২–২.৮ লক্ষ।
তালিকাটি এতটাই ‘গ্লোবাল’ যে পাঠকরা অবাক—বাংলাদেশ, মিশর বা সুদান যেমন অসংগঠিত শ্রমবাজারে দারিদ্র্যের কারণে ভিক্ষাবৃত্তির সমস্যায় ভোগে, তেমনই উন্নত বিশ্বের দেশ যেমন ফ্রান্স ও আমেরিকাও নাকি তালিকার প্রথম দশে! ফলে প্রশ্ন উঠছে—এগুলো কি সত্যিই ‘ভিক্ষুক’ নাকি বাস্তবে এরা গৃহহীন নাগরিক বা সামাজিক সহায়তা থেকে বঞ্চিত মানুষদের গণনা?
পোস্টের আরেকটি ভাইরাল অংশে দাবি করা হয়েছে—পাকিস্তানে নাকি মাত্র ২০ লক্ষ ভিক্ষুকই বছরে ৪২ বিলিয়ন ডলার আয় তৈরি করে! এই সংখ্যাটি আরও বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস ট্রিবিউন–এর একাধিক বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই পরিষ্কার করে দিয়েছে, এ ধরনের বিশাল অঙ্কের কোনও সরকারি তথ্য নেই। সামাজিক গবেষকরাও সতর্ক করেছেন—অনেক সময় পাকিস্তানের ‘আলমাজিরি’ ধাঁচের ধর্মীয় আবাসিক শিক্ষাপদ্ধতিতে থাকা দরিদ্র শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে ঠেলে দেওয়া হয়, ফলে সংখ্যা নিয়ে অতিরঞ্জন হওয়াটা খুব সাধারণ।
মানবাধিকার সংস্থাগুলির অনুমান—শুধু উত্তর নাইজেরিয়াতেই ‘আলমাজিরি’ ব্যবস্থায় ১০ মিলিয়নের বেশি শিশু কখনও–সখনও রাস্তায় ভিক্ষা করে। ফলে পাকিস্তানের সংখ্যাও বহু গবেষণায় ২০–৪০ লক্ষের মধ্যে ওঠানামা করে। ‘৮ মিলিয়ন’ বা ‘৪২ বিলিয়ন ডলার’—উভয়ই বিশেষজ্ঞদের মতে অতিরঞ্জিত।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিও–র তথ্য বলছে, শহুরে দারিদ্র্য, রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট, এবং অসম সংগঠিত শ্রমবাজারের কারণে রাস্তায় বসবাসকারীর সংখ্যা বেশি হলেও ‘ভিক্ষুক’ হিসেবে সরাসরি চিহ্নিত করা কঠিন। ভিন্ন ভিন্ন গবেষণায় সংখ্যা ২০ থেকে ৫০ লক্ষের মধ্যে ওঠানামা করে।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা–সহ বড় শহরগুলিতে মৌসুমি বেকারত্ব ও অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের কারণে রাস্তায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বাড়ে, যাদের অনেককে ভিক্ষুক হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্য—“সংখ্যা বাড়তে পারে, কিন্তু আন্তর্জাতিক তুলনায় নির্ভরযোগ্য ডাটার অভাব রয়েছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন পশ্চিমের দেশগুলিতে বেগার (beggar) শব্দের বদলে homeless population হিসেব করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৬.৫ লক্ষ গৃহহীন ব্যক্তি রয়েছে অনেকে স্বল্পমেয়াদি কাজ করেন, অনেকে ভিক্ষা করেন। ফ্রান্সেও প্রায় ৩ লক্ষের বেশি গৃহহীন।
এগুলো ভিক্ষুকের তালিকায় ফেলা আদৌ যুক্তিযুক্ত কিনা, তা নিয়েই তৈরি হয়েছে প্রশ্ন। বিতর্কিত তালিকাটি যেমন ভাইরাল, তেমনই অসম্পূর্ণ। ভারত ১৪০ কোটির দেশ—স্বাভাবিকভাবেই গৃহহীন বা রাস্তার মানুষের সংখ্যা কম নয়। তবুও তালিকায় ভারতের নাম না থাকায় অনেকে মন্তব্য করছেন—“এটি রাজনৈতিকভাবে তৈরি গ্রাফিক, তথ্যভিত্তিক নয়।”
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ভারতে ১৭ লক্ষেরও বেশি গৃহহীন ছিলেন। ২০২১ সালের পরে আপডেটেড তথ্য নেই; ফলে সঠিক তুলনা করা কঠিন। বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা ‘তথ্য যাচাই ছাড়া তালিকা গ্রহণ করা উচিত নয়। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানীদের বক্তব্য বিশ্বে ‘ভিক্ষুক’ সংখ্যা নিয়ে কোনও স্বীকৃত আন্তর্জাতিক ডাটাবেস নেই। দেশের সামাজিক নিরাপত্তা, গৃহহীনতা, বেকারত্ব, অভ্যন্তরীণ সংঘাত এসব মিলেই প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার তালিকাগুলি সাধারণত রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করতে ব্যবহৃত হয়, তাই সেগুলিকে তথ্য হিসেবে গ্রহণ করা বিপজ্জনক।
যে তালিকাটি এখন ভাইরাল তা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত ও তথ্যগতভাবে দুর্বল। কিন্তু এটি আবারও তুলে ধরল দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রাস্তায় বসবাস ও মানবপাচারের মতো প্রশ্নগুলি এশিয়া–আফ্রিকা থেকে ইউরোপ–আমেরিকা পর্যন্ত সমানভাবে জরুরি। সংখ্যার মারপ্যাঁচ ছাড়াও, প্রতিটি দেশকে সামাজিক সুরক্ষা কাঠামো নিয়ে নতুন করে ভাবা উচিত—এটাই বিশেষজ্ঞদের মত।

