ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক কেন্দ্র মার্কিন বিমান হানায় “সম্পূর্ণ ও চূড়ান্ত ধ্বংস” হয়েছে৷ এমনটাই দাবি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ভাষায়, “Obliteration is an accurate term. Bullseye!!” অর্থাৎ, ‘‘সম্পূর্ণ ধ্বংসই সঠিক শব্দ। একেবারে লক্ষ্যভেদ!!
তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্যাটেলাইট চিত্র ও গোয়েন্দা রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন দাবি ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। অনেক ক্ষেত্রে বড়সড় বিস্ফোরণের চিহ্ন মিলেছে ঠিকই, কিন্তু বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিকাঠামো অক্ষত রয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে, ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক ইউনিটগুলোর ক্ষয়ক্ষতি এখনও নিশ্চিত নয়।
Fordow: সুড়ঙ্গ মুখ ধসে পড়েছে, কিন্তু ভেন্টিলেশন ভবন অক্ষত
তেহরানের দক্ষিণে একটি পাহাড়ের গা ঘেঁষে তৈরি Fordow Fuel Enrichment Plant-এ মার্কিন GBU-57 বোমার আঘাতে সুড়ঙ্গের প্রবেশপথ ধসে পড়েছে, পাহাড়ের উপরে গর্ত তৈরি হয়েছে। উপগ্রহ চিত্রে বিস্ফোরণের চিহ্ন স্পষ্ট।
তবে এই পারমাণবিক ইউনিটের জন্য প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেশন কন্ট্রোল ভবন অক্ষত রয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ফলে ভিতরে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধিকরণের প্রকৃত ধ্বংস কতটা হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
Natanz: বড় গর্ত দৃশ্যমান, ভিতরের ক্ষতি নিয়ে ধোঁয়াশা US Strikes Iran Assessment
অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র নাতান্জ (Natanz)-এ আঘাত হানার পর একটি প্রায় ৫.৫ মিটার চওড়া গর্ত লক্ষ্য করা গিয়েছে। যদিও এই পারমাণবিক স্থাপনাটির মূল ইউনিট ৪০ মিটার গভীরে, এবং ৮ মিটার পুরু কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে ঘেরা। ফলে সেই আঘাতে ভিতরের অংশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এখনও জানানো হয়নি।
Esfahan: সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্র
উপগ্রহ চিত্র অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে Esfahan Nuclear Technology and Research Center-এ। এই গবেষণাকেন্দ্রটি তেহরান থেকে প্রায় ৪৫০ কিমি দূরে অবস্থিত এবং বিস্ফোরণে বিশাল এলাকাজুড়ে ধ্বংসের ছবি মিলেছে।
হামলার আগেই সরিয়ে ফেলা হয় ইউরেনিয়াম!
এই পরিস্থিতিতে আরও বড় প্রশ্ন তুলছে নতুন গোয়েন্দা রিপোর্ট। আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সূত্রের দাবি, মার্কিন হামলার ঠিক আগেই ইরান প্রায় ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম গোপনে অন্যত্র সরিয়ে নিতে সক্ষম হয়।
সাম্প্রতিক স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা গিয়েছে, Fordow পারমাণবিক কেন্দ্রের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে একাধিক যানবাহন। সেই দৃশ্যকে “অস্বাভাবিক কার্যকলাপ” বলে ব্যাখ্যা করেছে পর্যালোচকরা।
তবে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া তথ্যে দু’জন ইরানি কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন, হামলার সম্ভাবনা আঁচ করে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম সরিয়ে ফেলা হয়েছিল আগেভাগেই।
এই পদক্ষেপ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যে ধাক্কা দিচ্ছে- কারণ তিনি জোর গলায় বলেছিলেন, মার্কিন হামলায় ইরানের পারমাণবিক ক্ষমতা “সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস” হয়েছে।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন এখনও বাকি, তৎপর IAEA
মার্কিন বিমান বাহিনীর জেনারেল ড্যান কেইন জানিয়েছেন, “Battle Damage Assessment” এখনও চূড়ান্ত হয়নি। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (IAEA)-ও ইরানে ক্ষয়ক্ষতির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করছে।
মধ্যপ্রাচ্যে বাড়ছে উদ্বেগ, ভারতেরও উদ্বেগ প্রকাশ
ইরান এই হামলাকে “সরাসরি আগ্রাসন” বলে অভিহিত করে প্রতিশোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই জানিয়েছেন, “এই অপরাধের শাস্তি হবে কঠিন ও অবশ্যম্ভাবী।” ইতিমধ্যেই ইরান ইসরায়েলের ওপর পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে।
অন্যদিকে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সকল পক্ষকে সংযম ও উত্তেজনা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক মহলের চোখ ইরান-আমেরিকা সংঘাতের দিকেই। মার্কিন হামলার প্রকৃত প্রভাব ঠিক কতটা, সেটি হয়তো সময়ই বলবে। তবে এখনই এটা পরিষ্কার ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেমে গেলেও, মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা থামছে না।