মাসের পর মাস স্থবির কূটনীতি, বাতিল হয়ে যাওয়া ট্রাম্প–পুতিন শীর্ষ সম্মেলন এবং ইউক্রেনে বেসামরিক নাগরিকদের উপর নতুন রুশ হামলার পর অবশেষে নড়েচড়ে বসল ওয়াশিংটন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রথম ইউক্রেন-সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করল— নিশানায় সরাসরি রাশিয়ার দুই বৃহত্তম তেল জায়ান্ট, রসনেফ্ট (Rosneft) এবং লুকোইল (Lukoil)।
মার্কিন অর্থ মন্ত্রক জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য ক্রেমলিনের যুদ্ধযন্ত্রের আর্থিক রসদ বন্ধ করা। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে থাকা কোম্পানিগুলির সম্পদ ফ্রিজ করা হবে এবং মার্কিন নাগরিক বা ব্যবসা সংস্থার সঙ্গে তাদের কোনও লেনদেন নিষিদ্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছে রসনেফ্ট ও লুকোইলের ডজনাধিক সহযোগী সংস্থাও।
রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা
এই ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রুশ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত সাতজন। একই দিনে মস্কো একটি পরমাণু সামরিক মহড়াও চালায়, যেখানে স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র, সাবমেরিন ও লং রেঞ্জ বোমার ব্যবহার করা হয়।
মার্কিন অর্থমন্ত্রী স্কট বেসেন্ট এক বিবৃতিতে বলেন, “এখনই হত্যাযজ্ঞ থামানোর সময়। এখনই যুদ্ধবিরতির সময়। প্রেসিডেন্ট পুতিন যখন এই অর্থহীন যুদ্ধ থামাতে অস্বীকার করছেন, তখন ট্রেজারি রাশিয়ার দুটি বৃহত্তম তেল কোম্পানিকে নিষিদ্ধ করছে, যারা ক্রেমলিনের যুদ্ধযন্ত্রকে অর্থ জোগাচ্ছে।”
বিবিসি-র তথ্য অনুযায়ী, রসনেফ্ট একাই রাশিয়ার প্রায় অর্ধেক তেল উৎপাদনের জন্য দায়ী। রসনেফ্ট ও লুকোইল একত্রে দৈনিক প্রায় ৩.১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রফতানি করে। তেল-গ্যাস খাত রাশিয়ার মোট সরকারি আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস, যা বৈশ্বিক সরবরাহের প্রায় ছয় শতাংশ।
কেন এখন? ট্রাম্পের অবস্থান বদলাল কীভাবে US sanctions Rosneft Lukoil
দীর্ঘদিন দ্বিধায় ছিলেন ট্রাম্প। রাশিয়ার জ্বালানি খাতে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে তিনি কূটনৈতিক পথ খোলা রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে বুদাপেস্টে নির্ধারিত ট্রাম্প–পুতিন শীর্ষ বৈঠক বাতিল হয়ে যাওয়ার পর হোয়াইট হাউসের মনোভাব বদলায়।
ট্রাম্প বলেন, “আমাদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ ছিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল আমরা যেখানে পৌঁছাতে চাই সেখানে যাচ্ছি না।” তিনি আরও যোগ করেন, “প্রতিবারই পুতিনের সঙ্গে আমার ভালো আলোচনা হয়, কিন্তু পরে কিছুই ঘটে না। তাই এবার মনে হল সময় এসেছে। আমরা অনেক দিন অপেক্ষা করেছি।”
ইউরোপ ও ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়া
ওয়াশিংটনের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও ঘোষণা করেছে তাদের ১৯তম নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ।
এই নতুন ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—
রুশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) আমদানিতে ধাপে ধাপে নিষেধাজ্ঞা
রুশ কূটনীতিকদের ভ্রমণ সীমাবদ্ধতা
রাশিয়ার তথাকথিত “শ্যাডো ফ্লিট”-এর আরও ১১৭টি ট্যাঙ্কার ব্ল্যাকলিস্ট, যার ফলে নিষিদ্ধ জাহাজের মোট সংখ্যা দাঁড়াল ৫৫৮৷ ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফন ডার লেয়েন ‘এক্স’-এ (সাবেক টুইটার) লিখেছেন, “ইইউ-র ১৯তম প্যাকেজ গ্রহণের সঙ্গে আমেরিকার এই সিদ্ধান্ত এক যৌথ বার্তা— আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ট্রান্সআটলান্টিক ঐক্য অব্যাহত থাকবে।”
ব্রিটেন-এর আগেই রসনেফ্ট ও লুকোইলকে নিষিদ্ধ করেছে। ব্রিটিশ চ্যান্সেলর র্যাচেল রিভস স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “বিশ্ববাজারে রুশ তেলের আর কোনও জায়গা নেই।”
কিন্তু ভারত ও চিন ছাড়া এই নিষেধাজ্ঞা কতটা কার্যকর?
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার জ্বালানি রফতানি বন্ধ করা অসম্ভব যতক্ষণ না চিন, ভারত এবং তুরস্ক-এর মতো বড় ক্রেতারা একই পথে হাঁটে।
প্রাক্তন মার্কিন কূটনীতিক এডওয়ার্ড ফিশম্যান বলেন, “এই পদক্ষেপ এককালীন হতে পারে না। প্রশ্ন হল, আমেরিকা কি পরবর্তী ধাপে সেই সব দেশ বা সংস্থার উপরও নিষেধাজ্ঞা দেবে, যারা এখনও রসনেফ্ট বা লুকোইলের সঙ্গে ব্যবসা করছে?”
মার্কিন ট্রেজারির প্রাক্তন তদন্তকারী জেরেমি প্যানার সতর্ক করে বলেন, “ব্যাঙ্ক বা ভারত–চিনের ক্রেতাদের অন্তর্ভুক্ত না করলে এই নিষেধাজ্ঞা পুতিনের মনোযোগ টানবে না।”
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প জানিয়েছেন, তিনি আশা করেন নিষেধাজ্ঞা “অল্প সময়ের মধ্যেই তুলে নেওয়া যাবে”— যদি যুদ্ধ থামে। তাঁর কথায়, “আমি চাই না এগুলি দীর্ঘস্থায়ী হোক। যুদ্ধ শেষ হোক, তাহলেই যথেষ্ট।”
কিয়েভের প্রতিক্রিয়া
ইউক্রেন দীর্ঘদিন ধরে রাশিয়ার জ্বালানি রফতানির ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাই ওয়াশিংটনের এই সিদ্ধান্তে কিয়েভ সন্তুষ্ট।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইউক্রেনের রাষ্ট্রদূত ওল্গা স্টেফানিশিনা এক্স-এ লিখেছেন, “এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের অবস্থানের সঙ্গে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ— শান্তি কেবল শক্তি ও আগ্রাসীর ওপর সর্বাত্মক আন্তর্জাতিক চাপের মাধ্যমেই সম্ভব।”
অন্যদিকে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আবারও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লং-রেঞ্জ টোমাহক ক্ষেপণাস্ত্র চেয়েছেন। তবে ট্রাম্প জানিয়েছেন, “ওটা ব্যবহার করতে ইউক্রেনের অন্তত ছয় মাস লাগবে।”
যুদ্ধের গতি কি বদলাবে এই চাপের ফলে?
ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে এটি প্রথমবারের মতো সরাসরি অর্থনৈতিক চাপের ব্যবহার, যা ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। এবার লক্ষ্য রাশিয়ার জ্বালানি খাত— ক্রেমলিনের বাজেটের মূল অবলম্বন।
রসনেফ্ট ও লুকোইল মিলে প্রতিদিন তিন মিলিয়নের বেশি ব্যারেল তেল রফতানি করে। এই উৎস বন্ধ করা মানে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রের অক্সিজেন কেটে দেওয়া।
তবুও দুইটি সীমাবদ্ধতা থেকে যাচ্ছে-
প্রথমত, এগুলি প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা (primary sanctions); অর্থাৎ, শুধুমাত্র মার্কিন সংস্থা বা নাগরিকদের ওপর প্রযোজ্য। এখনও পর্যন্ত দ্বিতীয় পর্যায়ের নিষেধাজ্ঞা (secondary sanctions) চালু হয়নি, যা অন্য দেশের কোম্পানিকেও শাস্তির আওতায় আনতে পারে।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি একটি গ্লোবালি ইন্টারডিপেনডেন্ট পণ্য— ইউরোপ ও আমেরিকা একসঙ্গে পদক্ষেপ নিলেও চিন, ভারত ও তুরস্ক নিজেদের অবস্থান বদলাবে না বলেই জানিয়েছে।
ফলে এই পদক্ষেপের কার্যকারিতা যতটা না সংখ্যায়, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক ঐক্যের গভীরতার ওপর।
ফক্স বিজনেস-এ সাক্ষাৎকারে বেসেন্ট বলেছেন, “এগুলি সাধারণ শুল্ক নয়— এগুলি বাস্তব ও প্রভাবশালী নিষেধাজ্ঞা। আমরা ইউরোপ, জি৭, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াকে আমাদের সঙ্গে থাকতে আহ্বান জানাচ্ছি।”
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের এই নীতিগত মোড় স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে— কূটনৈতিক সমঝোতার আশা ম্লান, এবং এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক ক্ষয়যুদ্ধের মাধ্যমে মস্কোকে চাপে ফেলা।
তবে এই চাপ পুতিনকে নমনীয় করবে— এমন নিশ্চয়তা নেই। বরং, তা উল্টো প্রতিক্রিয়া ডেকে আনতে পারে। ক্রেমলিন ইতিমধ্যেই ডনবাসের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে এবং ট্রাম্পের “ফ্রিজ দ্য ফ্রন্টলাইনস” প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে।
এই পরিস্থিতিতে, যুদ্ধ থামার চেয়ে বরং আরও কঠিন কূটনৈতিক অচলাবস্থার দিকে এগোচ্ছে পৃথিবী।
