পাকিস্তানের (Pakistan) গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আবারও আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক মঞ্চ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান জো উইলসন গতকাল, বুধবার, ঘোষণা করেছেন যে তিনি ‘পাকিস্তান ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট’ নামে একটি আইনের খসড়া প্রায় শেষ করেছেন। এই প্রস্তাবিত আইনের লক্ষ্য পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং দেশটির সেনাপ্রধান সৈয়দ আসিম মুনির আহমেদ শাহ’র ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য ৩০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া। এই খবর পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
‘পাকিস্তান ডেমোক্রেসি অ্যাক্ট’ কী বলে?
জো উইলসন তার সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছেন, এই আইনের মূল উদ্দেশ্য তিনটি:
১. পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠাকে মার্কিন নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
২. পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়ে ৩০ দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়া।
৩. পাকিস্তানের সব জেনারেল, সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞার জন্য পর্যালোচনা করা।
এই আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, পাকিস্তানে যারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের “অন্যায়ভাবে” আটক ও কারারুদ্ধ করার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। উইলসন এর আগে এই মাসের শুরুতে জানিয়েছিলেন, তিনি এমন একটি আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছেন যা পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের “অন্যায় কারাবাসের” জন্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করবে।
ইমরান খানের কারাবাস ও গণতন্ত্রের প্রশ্ন
পাকিস্তানের রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরে অস্থিরতা চলছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ২০২৩ সালে গ্রেফতার করা হয় এবং তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও রাষ্ট্রদ্রোহের মতো একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) অভিযোগ করেছে, এই মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং সামরিক বাহিনীর সমর্থনে বর্তমান সরকার এগুলো চালাচ্ছে। ইমরান খানের সমর্থকরা মনে করেন, তার কারাবাস পাকিস্তানে গণতন্ত্রের অবসানের প্রতীক।
জো উইলসন তার বক্তব্যে বলেছেন, “পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ইমরান খানকে কারারুদ্ধ করে গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করতে হয়, জেলে পুরে নয়।” তিনি পাকিস্তানের শাসকদের প্রতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে সম্মান করার আহ্বান জানিয়েছেন।
আসিম মুনির ও পাকিস্তানের সামরিক ভূমিকা
পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির ২০২২ সালের নভেম্বরে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী দেশের রাজনীতিতে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বছর পাকিস্তানের পার্লামেন্টে একটি আইন পাস হয়, যা আসিম মুনিরের মেয়াদ ২০২৫ থেকে ২০২৭ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। পিটিআই এই আইনকে “গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক” বলে সমালোচনা করেছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, আসিম মুনির পাকিস্তানে বর্তমানে প্রকৃত ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন, এবং বেসামরিক সরকার তার নির্দেশে চলছে।
মার্কিন এই প্রস্তাবিত আইনে আসিম মুনিরের ওপর নিষেধাজ্ঞার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা পাকিস্তানের সামরিক নেতৃত্বের জন্য একটি বড় ধাক্কা হতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সম্পদ জব্দ করা এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এছাড়া, অন্যান্য জেনারেল ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও তদন্তের আওতায় আনা হবে, যা পাকিস্তানের ক্ষমতার গোটা কাঠামোর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
Grateful to be nearly finished drafting the PAKISTAN DEMOCRACY ACT. The bill:
– Sets down that it is US policy to restore democracy in Pakistan
– Mandates a 30-day determination of sanctions on Asim Munir
– Reviews all generals & gov officials & their families for sanctions pic.twitter.com/g5FU0T4cMz— Joe Wilson (@RepJoeWilson) February 26, 2025
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও এই প্রস্তাবের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেনি। তবে, ইতিপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরূপ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তান “দ্বিমুখী নীতি” এবং “ভেদাভেদমূলক আচরণের” অভিযোগ তুলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত চারটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, যাকে পাকিস্তান “অযৌক্তিক ও পক্ষপাতমূলক” বলে সমালোচনা করেছে। এই নতুন আইনের প্রস্তাব পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
এই ঘোষণার সময়টা লক্ষণীয়। একই দিনে, তাইওয়ান চীনের “সতর্কতা ছাড়াই” লাইভ-ফায়ার সামরিক মহড়ার জবাবে নিজেদের বাহিনী মোতায়েন করেছে, যাকে তাইওয়ান “উষ্কানিমূলক” বলে অভিহিত করেছে। এই ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে উত্তেজনা বাড়াচ্ছে। এর মধ্যেই পাকিস্তানের গণতন্ত্র নিয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রস্তাব এসেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।
পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
পাকিস্তানের ইতিহাসে সামরিক বাহিনী বারবার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে। ইমরান খানের কারাবাস এবং পিটিআই-এর ওপর দমন-পীড়ন অনেকের কাছে এই প্রবণতারই প্রতিফলন। জো উইলসনের এই আইনের প্রস্তাব পাকিস্তানের গণতন্ত্রপন্থীদের আশা জাগালেও, এর বাস্তবায়ন কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পাকিস্তানের বর্তমান সরকার ও সামরিক নেতৃত্ব এই প্রস্তাবকে কীভাবে নেবে, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে।
ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে তার সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী পাকিস্তানিদের সঙ্গে মিলে বিক্ষোভ করছেন। লন্ডনে সম্প্রতি আসিম মুনিরের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের হয়েছে, যেখানে তাকে “ইসলামাবাদ গণহত্যা”র জন্য দায়ী করা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।