মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সোমবার (৭ এপ্রিল) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুকে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক সাক্ষাতে বলেছেন যে, তিনি চান গাজায় চলমান যুদ্ধ শীঘ্রই (Gaza war) বন্ধ হোক। এই সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন যে, হামাসের হাতে আটক বন্দিদের মুক্ত করার জন্য কাজ চলছে, তবে সমস্ত বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করা একটি “দীর্ঘ প্রক্রিয়া”। এই বৈঠকটি গাজার যুদ্ধ, বন্দি মুক্তি এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে।
ট্রাম্প তার বক্তব্যে বলেন, “গাজায় যুদ্ধ চলছে, এবং আমি চাই এটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ হয়। আমরা বন্দিদের মুক্ত করার জন্য কাজ করছি। তবে এটি একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া।” তিনি আরও জানান যে, তিনি এবং নেতানিয়াহু এই বিষয়ে গভীর আলোচনা করেছেন এবং মার্কিন প্রশাসন এই সংকট সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই বৈঠকটি ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে নেতানিয়াহুর সঙ্গে দ্বিতীয় সাক্ষাৎ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, যা গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ১৮ মাস ধরে চলা যুদ্ধের মধ্যে ঘটল।
গত ৭ অক্টোবর, ২০২৩-এ হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে হামলার পর থেকে গাজায় যুদ্ধ শুরু হয়। সেই হামলায় প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত এবং ২৫১ জনকে বন্দি করা হয়। জবাবে ইসরায়েল গাজায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে, যার ফলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ৫০,৭৫০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই যুদ্ধের মধ্যে বন্দিদের মুক্তি এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে রয়ে গেছে। ইসরায়েলের তথ্য অনুযায়ী, এখনও ৫৯ জন বন্দি গাজায় আটক রয়েছে, যাদের মধ্যে অন্তত ২৪ জন জীবিত আছে বলে ধারণা করা হয়।
নেতানিয়াহু এই সাক্ষাতে বলেন, “আমরা আমাদের সমস্ত বন্দিদের, জীবিত এবং মৃত উভয়কেই ফিরিয়ে আনার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাব।” তিনি গাজায় হামাসকে পরাজিত করা এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। তবে, তিনি এও স্বীকার করেন যে, বন্দি মুক্তির প্রক্রিয়া জটিল এবং এটি সময়সাপেক্ষ। এর আগে ট্রাম্প হামাসকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে, বন্দিদের মুক্ত না করলে “বড় মূল্য” চোকাতে হবে। এই হুঁশিয়ারির পর মার্কিন প্রশাসন হামাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছে, যা মার্কিন নীতির একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
গত জানুয়ারিতে মিশর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, যার প্রথম পর্যায়ে কিছু বন্দি মুক্তি পায়। তবে, দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার পর ইসরায়েল আবারও সামরিক অভিযান শুরু করে এবং গাজায় ত্রাণ সরবরাহের উপর পাঁচ সপ্তাহের নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এই নিষেধাজ্ঞার জন্য জাতিসংঘ এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে, যারা এটিকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হামাসের উপর চাপ সৃষ্টি করে বন্দিদের মুক্তি নিশ্চিত করা এবং শেষ পর্যন্ত এই সংগঠনকে নির্মূল করা।
ট্রাম্প এই বৈঠকে গাজার ভবিষ্যৎ নিয়েও কথা বলেন। তিনি এর আগে প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে, গাজাকে “মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা” হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে এবং ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। তবে, এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে হামাসের মুখপাত্র সামি আবু জুহরি বলেন, “আমাদের গাজার মানুষ এই পরিকল্পনা মেনে নেবে না। আমাদের দাবি হল দখলদারি ও আগ্রাসন বন্ধ করা, আমাদের ভূমি থেকে মানুষকে উৎখাত করা নয়।” এছাড়া, মিশর, জর্ডান, সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোও ফিলিস্তিনিদের স্থানান্তরের বিরোধিতা করেছে।
নেতানিয়াহু এই সফরে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক নীতি নিয়েও আলোচনা করেন, যার অধীনে ইসরায়েলি পণ্যের উপর ১৭ শতাংশ শুল্ক আরোপিত হয়েছে। এই শুল্কের ফলে ইসরায়েলের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ইসরায়েলের শিল্প সমিতির এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এতে ২.৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হতে পারে এবং ১৮,০০০ থেকে ২৬,০০০ মানুষের চাকরি হারানোর ঝুঁকি রয়েছে।
এই সাক্ষাৎ গাজার যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি মুক্তির প্রক্রিয়ায় একটি নতুন মোড় আনতে পারে। ট্রাম্পের শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি এবং নেতানিয়াহুর কঠোর অবস্থানের মধ্যে সমন্বয় কীভাবে হবে, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে।