আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শুক্রবার আলাস্কায় একটি উচ্চ-প্রোফাইল বৈঠকের জন্য যাত্রা করার সময় এয়ার ফোর্স ওয়ানে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন যে তিনি ইউক্রেনের পক্ষে কোনও আলোচনা করতে যাচ্ছেন না। তাঁর লক্ষ্য হলো রাশিয়া এবং ইউক্রেনকে (Russia-Ukraine Conflict) শান্তি আলোচনার টেবিলে আনা, যেখানে ভূখণ্ড বিনিময়ের মতো বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনের হাতে ছেড়ে দেওয়ার কথা জানিয়েছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্প বলেন, “ভূখণ্ড বিনিময় নিয়ে আলোচনা হবে, তবে এই সিদ্ধান্ত ইউক্রেনকেই নিতে হবে। আমি মনে করি তারা সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। আমি এখানে ইউক্রেনের পক্ষে আলোচনা করতে আসিনি, আমি এসেছি তাদের আলোচনার টেবিলে আনতে।” এই বক্তব্য ইউক্রেনের জন্য কিছুটা আশ্বাসের হতে পারে, কারণ ইউক্রেন আশঙ্কা করছে যে আমেরিকা-রাশিয়া বৈঠক তাদের ক্ষতির দিকে নিয়ে যেতে পারে এবং যুদ্ধকে ‘ফ্রিজ’ করে দিতে পারে।
ট্রাম্পের এই বৈঠক আলাস্কার জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে অনুষ্ঠিত হবে। এটি এমন একটি সময়ে হচ্ছে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে মারাত্মক সংঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ট্রাম্প, যিনি ২০২৪-এর নির্বাচনী প্রচারণায় যুদ্ধ দ্রুত শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, এই বৈঠকে পুতিনের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্কের উপর ভরসা রাখছেন। তিনি বলেন, “পুতিন একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি, দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করছেন, কিন্তু আমিও তাই। আমাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক রয়েছে, পারস্পরিক সম্মান রয়েছে। আমি মনে করি, এই বৈঠক থেকে কিছু ফলাফল আসবে।”
পুতিনের কৌশল এবং ট্রাম্পের সতর্কতা
ট্রাম্প মনে করেন, রাশিয়ার সাম্প্রতিক সামরিক আক্রমণ ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ফ্রন্টলাইনে পুতিনের আলোচনার অবস্থানকে শক্তিশালী করার কৌশল। তিনি বলেন, “পুতিন মনে করেন এটি তাঁর জন্য ভালো চুক্তি আনতে সাহায্য করবে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি তাঁর জন্য ক্ষতিকর। এই ধরনের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া তাঁর আলোচনার অবস্থানকে দুর্বল করে। আমি এই বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলব।” ট্রাম্প আরও সতর্ক করে বলেন, যদি পুতিন যুদ্ধ শেষ করতে গুরুতর আগ্রহ না দেখান, তবে রাশিয়ার জন্য “অর্থনৈতিকভাবে গুরুতর পরিণতি” হবে। তিনি রাশিয়ার অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “রাশিয়ার অর্থনীতি ভালো অবস্থায় নেই। তারা শান্তি চায়, কারণ তাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল।”
ট্রাম্প লক্ষ্য করেছেন যে পুতিন তাঁর সঙ্গে বৈঠকে রাশিয়ার ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে আসছেন, যা তিনি একটি ইতিবাচক সংকেত হিসেবে দেখছেন। তবে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছেন, “তারা ব্যবসা করতে চায়, কিন্তু যুদ্ধ সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনও ব্যবসা করব না।” এই বক্তব্যে ট্রাম্প রাশিয়ার উপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
ইউক্রেনের উদ্বেগ এবং জেলেনস্কির অবস্থান
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই বৈঠকে আমন্ত্রিত হননি, যা তাঁর এবং ইউক্রেনের সমর্থকদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেলেনস্কি স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ইউক্রেন কোনও ভূখণ্ড রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করবে না, কারণ এটি তাঁর দেশের সংবিধানের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, “ইউক্রেন দখলদারদের কাছে তাদের ভূমি দেবে না।” তিনি আরও জোর দিয়ে বলেছেন যে শান্তি আলোচনার জন্য আমেরিকার দৃঢ় অবস্থান প্রয়োজন, কারণ রাশিয়া আমেরিকার শক্তির উপর নির্ভর করে।
ট্রাম্প এই উদ্বেগের জবাবে বলেছেন, তিনি ইউক্রেনের জন্য নিরাপত্তা গ্যারান্টি প্রদানের বিষয়ে উন্মুক্ত, তবে তা ন্যাটোর মাধ্যমে হবে না। তিনি বলেন, “ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিলে এই ধরনের গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব, তবে ন্যাটোর আকারে নয়। কিছু বিষয় ঘটতে দেওয়া যাবে না।”
বৈঠকের প্রত্যাশা এবং সমালোচনা
বিশ্লেষকরা এই বৈঠক থেকে কোনও বড় সাফল্যের আশা কম রাখছেন। রাশিয়ার প্রাক্তন উপদেষ্টা স্যামুয়েল চারাপ মনে করেন, পুতিন এই বৈঠককে ট্রাম্পের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য ব্যবহার করতে চাইবেন, যাতে আমেরিকার পক্ষ থেকে আরও নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক সহায়তা এড়ানো যায়। তিনি বলেন, “একটি যুদ্ধবিরতি এবং ভবিষ্যৎ আলোচনার জন্য একটি রোডম্যাপ হতে পারে সেরা ফলাফল।”
এদিকে, ইউক্রেন এবং ইউরোপীয় নেতারা আশঙ্কা করছেন যে ট্রাম্প পুতিনের কাছে বেশি ছাড় দিতে পারেন। মার্কিন সিনেটের গোয়েন্দা কমিটির শীর্ষ ডেমোক্র্যাট মার্ক ওয়ার্নার বলেন, “আমি আশঙ্কা করি এই বৈঠক আবারও আমেরিকার পক্ষ থেকে একজন স্বৈরশাসকের কাছে ছাড় দেওয়ার মতো ফলাফল আনতে পারে, যিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন।”
ইউক্রেনের নাগরিকরাও এই বৈঠক নিয়ে আশাবাদী নন। কিয়েভের একজন বাসিন্দা তেতিয়ানা হারকাভেনকো বলেন, “এই বৈঠক থেকে কিছু ভালো হবে না। আমরা আমাদের ভূমি কাউকে দেব না।”
ট্রাম্প এবং পুতিনের এই বৈঠক ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির দিকে জোর দিলেও, তিনি ইউক্রেনের সিদ্ধান্তের উপর নজর রাখছেন এবং ন্যাটোর বিষয়ে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তবে, জেলেনস্কির কঠোর অবস্থান এবং ইউক্রেনের সংবিধানের সীমাবদ্ধতা এই আলোচনাকে জটিল করে তুলেছে। এই বৈঠকের ফলাফল কী হবে, তা সময়ই বলবে, তবে এটি নিঃসন্দেহে বিশ্ব রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত।