বিশ্ব রাজনীতিতে এক বিস্ফোরক মোড়। দীর্ঘ ৩৩ বছর পর ফের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা করলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া আমেরিকার স্বেচ্ছা-নিষেধাজ্ঞা বা moratorium শেষ করে বৃহস্পতিবার বুসান বৈঠকের ঠিক আগে এই ঘোষণা করেন ট্রাম্প। ফলে একদিকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সাক্ষাৎ, অন্যদিকে পারমাণবিক নীতি নিয়ে এমন নাটকীয় ঘোষণা, দুই ঘটনাই বিশ্ব মঞ্চে নতুন ভারসাম্য তৈরি করতে পারে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞ মহল।
আমেরিকার কাছে অস্ত্র ভাণ্ডার
ট্রাম্প তাঁর Truth Social পোস্টে লেখেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে। রাশিয়া দ্বিতীয় স্থানে, আর চিন অনেক পিছনে, কিন্তু আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে তারা সমকক্ষ হয়ে উঠবে। তাই আমি প্রতিরক্ষা দফতরকে নির্দেশ দিয়েছি, অবিলম্বে আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার প্রক্রিয়া শুরু করা হোক।”
তিনি আরও দাবি করেন, প্রথম প্রেসিডেন্ট মেয়াদেই আমেরিকার পারমাণবিক অস্ত্রাগারের “সম্পূর্ণ পুনর্গঠন ও আধুনিকীকরণ” করেছেন তিনি। ট্রাম্পের কথায়, “এই বিশাল ধ্বংসক্ষমতার কারণে আমি করতে চাইনি, কিন্তু অন্য দেশগুলির পরীক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে আর কোনও উপায় ছিল না।”
ইতিহাসে নতুন অধ্যায়: ৩০ বছরের নিষেধাজ্ঞা ভাঙছে আমরিকা Trump Nuclear Test Moratorium End
১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেভাডা টেস্ট সাইটে হয়েছিল আমেরিকার শেষ পারমাণবিক পরীক্ষা। তারপর থেকে আমেরিকা নির্ভর করছিল উন্নত কম্পিউটার সিমুলেশন ও subcritical পরীক্ষার উপর। এবার ট্রাম্পের নির্দেশে সেই সীমা ভেঙে যাচ্ছে।
এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে তা হবে আমেরিকার তিন দশকের পারমাণবিক সংযম নীতির অবসান— যা বিশ্ব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এর ফলে ফের শুরু হতে পারে এক নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা।
বিশ্বশক্তির ভারসাম্যে নয়া সঙ্কেত
ট্রাম্পের ঘোষণার সময়টিও তাৎপর্যপূর্ণ। সম্প্রতি রাশিয়া সফলভাবে পরীক্ষা করেছে Burevestnik পারমাণবিকচালিত ক্রুজ মিসাইল ও Poseidon নিউক্লিয়ার টর্পেডো, যা মার্কিন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কাটিয়ে আঘাত হানার ক্ষমতা রাখে।
অন্যদিকে, চিন গত পাঁচ বছরে তাদের পারমাণবিক অস্ত্রাগারের পরিমাণ দ্বিগুণ করেছে। ২০২০ সালে যেখানে চিনের হাতে ছিল প্রায় ৩০০ ওয়ারহেড, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৬০০। CSIS–এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সেই সংখ্যা ১,০০০ ছুঁতে পারে।
বেইজিংয়ের সাম্প্রতিক সামরিক প্যারেডে প্রদর্শিত হয়েছে অন্তত পাঁচ ধরনের নতুন পারমাণবিক মিসাইল, যা সরাসরি মার্কিন মূলভূখণ্ডে পৌঁছাতে সক্ষম। ফলে ট্রাম্পের এই ঘোষণা নিছক অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত নয়, বরং রাশিয়া ও চিনের প্রতি স্পষ্ট কৌশলগত বার্তা।
কূটনৈতিক সঙ্কেত ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা
বুসানে শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের কয়েক মিনিট আগেই এমন ঘোষণা নিঃসন্দেহে বার্তা বহন করছে। ট্রাম্প এর আগে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন, “মিসাইল পরীক্ষা নয়, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করাতেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।”
কিন্তু এই ঘোষণার ফলে উল্টে আমেরিকারই পারমাণবিক পদক্ষেপ নিয়ে নতুন প্রশ্ন উঠছে। Comprehensive Nuclear-Test-Ban Treaty (CTBT)–তে স্বাক্ষর করলেও যুক্তরাষ্ট্র আজও তা অনুমোদন করেনি, এই প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক পরমাণু সংযমের নীতিকাঠামোকে আরও দুর্বল করে দিতে পারে।
বিশ্লেষণ: ‘নিউক্লিয়ার যুগের দ্বিতীয় অধ্যায়’?
বিশ্লেষকদের মতে, ট্রাম্পের এই ঘোষণা শুধুমাত্র সামরিক কৌশল নয়, বরং বৈশ্বিক ক্ষমতার নতুন ভারসাম্য রচনার সংকেত। রাশিয়া ও চিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্র তার “অগ্রণী অবস্থান” পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথেই হাঁটছে।
তবে এর মূল্য হতে পারে ভয়াবহ, আন্তর্জাতিক অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এবং বিশ্বের সামনে আবারও পারমাণবিক প্রতিযোগিতার ছায়া।


