পাকিস্তানে রহস্যজনকভাবে খতম ভারত-বিরোধী জইশ কমান্ডার

পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের ভাক্কার জেলার আশরাফওয়ালায় জইশ-ই-মহম্মদের (জেএম) শীর্ষ কমান্ডার (Jaish-e-Mohammed Commander) মৌলানা আবদুল আজিজ এসার রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন…

Top Jaish-e-Mohammed Commander Abdul Aziz Esar Dies

পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের ভাক্কার জেলার আশরাফওয়ালায় জইশ-ই-মহম্মদের (জেএম) শীর্ষ কমান্ডার (Jaish-e-Mohammed Commander) মৌলানা আবদুল আজিজ এসার রহস্যজনক পরিস্থিতিতে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঘটনা ভারতের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা, কারণ আবদুল আজিজ এসার ভারতের বিরুদ্ধে একাধিক জঙ্গি হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যুর একটি ভিডিও বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, যা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। জেএম সূত্র দাবি করেছে যে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও নিশ্চিত হয়নি। তার জানাজা পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুরে জেএম-এর সদর দফতর মারকাজে অনুষ্ঠিত হবে। এই প্রতিবেদনে আমরা এসারের মৃত্যু, তার জঙ্গি কার্যকলাপ এবং এই ঘটনার তাৎপর্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

আবদুল আজিজ এসার কে ছিলেন?
আবদুল আজিজ এসার জইশ-ই-মহম্মদের একজন শীর্ষ কমান্ডার এবং কৌশলগত নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি জেএম-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং রাষ্ট্রসংঘের তালিকাভুক্ত বৈশ্বিক জঙ্গি মাসুদ আজহারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। এসার ভারতের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তৃতা দেওয়ার জন্য কুখ্যাত ছিলেন। তিনি পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং জনসভায় জিহাদের ডাক দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে জঙ্গি কার্যকলাপে উৎসাহিত করতেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে তাকে নজরদারিতে রেখেছিল, কারণ তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে সীমান্ত পেরিয়ে জঙ্গি কার্যকলাপ পরিকল্পনা এবং উস্কানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

   

এসার ২০১৬ সালের নাগরোটা হামলাসহ ভারতে একাধিক জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ছিলেন। তার বক্তৃতা এবং প্রচারণা ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে শত্রুতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরিচালিত হতো। সম্প্রতি তিনি ভারতের বিরুদ্ধে ‘বাল্কানাইজেশন’ বা বিভক্তিকরণের হুমকি দিয়েছিলেন, যা তার ভারতবিরোধী মনোভাবের আরেকটি প্রমাণ।

রহস্যজনক মৃত্যু
২০২৫ সালের ২ জুন সকালে আবদুল আজিজ এসারের দেহ তার একজন সহযোগী আশরাফওয়ালায় আবিষ্কার করেন। জেএম-এর সামাজিক মাধ্যমের এনক্রিপ্টেড চ্যানেলগুলোতে দাবি করা হয়েছে যে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাননি, তবে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ এখনও অজানা। কিছু সূত্র দাবি করেছে যে তিনি হৃদরোগে মারা গেছেন, তবে এটি স্বাধীনভাবে যাচাই করা যায়নি। পাকিস্তানের স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এখনও কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করেনি, এবং মৃত্যুস্থলটি কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে।

এই রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে এটি জেএম-এর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার লড়াই বা বহিরাগত গোপন অপারেশনের ফল হতে পারে। সম্প্রতি ভারতের অপারেশন সিঁদুরের পর জেএম-এর অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং নেতৃত্বের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে, যা এই জল্পনাকে আরও জোরদার করছে।

অপারেশন সিঁদুরের প্রেক্ষাপট
এসারের মৃত্যু এমন এক সময়ে ঘটেছে যখন ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা তুঙ্গে। ২০২৫ সালের ৭ মে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে একটি নির্ভুল হামলা চালায়, যা পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মীরে জেএম, লস্কর-ই-তৈবা এবং হিজবুল মুজাহিদিনের নয়টি জঙ্গি ঘাঁটি লক্ষ্য করে। এই অপারেশন ছিল ২৭ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিদের হামলার প্রতিক্রিয়া, যেখানে ২৬ জন, বেশিরভাগই পর্যটক, নিহত হয়েছিল।

অপারেশন সিঁদুরে জেএম-এর বাহাওয়ালপুরে অবস্থিত সদর দফতর মারকাজ সুবহান আল্লাহ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই হামলায় জেএম প্রধান মাসুদ আজহারের ১০ জন পরিবারের সদস্য এবং চারজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী নিহত হয়, যার মধ্যে তার বড় বোন, ভগ্নিপতি, ভাইপো এবং ভাইপোর স্ত্রী অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। মাসুদ আজহার নিজে এই হামলায় বেঁচে গেলেও, তার ভাই আবদুল রউফ আজহারও নিহত হন, যিনি জেএম-এর অপারেশনাল প্রধান এবং ১৯৯৯ সালের আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাইয়ের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন।

Advertisements

এই হামলা জেএম-এর কাঠামোতে বড় ধরনের ধাক্কা সৃষ্টি করেছে। আবদুল আজিজ এসারের মৃত্যু এই প্রেক্ষাপটে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, কারণ তিনি জেএম-এর শীর্ষ কৌশলগত নেতাদের একজন ছিলেন।

এসারের জঙ্গি কার্যকলাপ
আবদুল আজিজ এসার ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বড় জঙ্গি হামলার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ২০১৬ সালের নাগরোটা হামলা ছাড়াও, তিনি জম্মু ও কাশ্মীরে একাধিক জঙ্গি কার্যকলাপের পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন। তার উস্কানিমূলক বক্তৃতা পাকিস্তানের মাদ্রাসা এবং জনসভায় তরুণদের জিহাদে উৎসাহিত করত। এসারের এই কার্যকলাপ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে এবং সীমান্তে অস্থিরতা বাড়িয়েছে।

জল্পনা ও প্রভাব
এসারের মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা চলছে। কেউ কেউ মনে করছেন যে এটি জেএম-এর অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সংঘর্ষের ফল হতে পারে, কারণ সংগঠনটি অপারেশন সিঁদুরের পর নেতৃত্বের সংকটের মুখোমুখি হচ্ছে। অন্যরা মনে করছেন যে এটি একটি গোপন অপারেশনের ফল হতে পারে, যদিও এর কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নেই। পাকিস্তান সরকার এবং জেএম-এর নীরবতা এই রহস্যকে আরও গভীর করেছে।

এই মৃত্যু জেএম-এর কাঠামোর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। সংগঠনটি ইতিমধ্যে অপারেশন সিঁদুরে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, এবং এসারের মতো একজন শীর্ষ কমান্ডারের মৃত্যু তাদের পরিকল্পনা ও সংগঠনকে আরও দুর্বল করতে পারে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই ঘটনার উপর নজর রাখছে, এবং এটি ভবিষ্যতে সীমান্তে জঙ্গি কার্যকলাপের উপর প্রভাব ফেলতে পারে।

আবদুল আজিজ এসারের রহস্যজনক মৃত্যু ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক এবং সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অপারেশন সিঁদুরের পর জেএম-এর উপর চাপ বেড়েছে, এবং এসারের মৃত্যু সংগঠনটির জন্য আরেকটি ধাক্কা। তার ভারতবিরোধী কার্যকলাপ এবং জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা ভারতের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি ছিল। এই মৃত্যু জেএম-এর অভ্যন্তরীণ গতিশীলতা এবং ভবিষ্যৎ কার্যক্রমের উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে। তবে, ভারতের জন্য এটি একটি ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দেশের দৃঢ় অবস্থানের প্রতিফলন।