দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক ড্রাইভিং দেশ (Dangerous Country to Drive) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই তথ্য উঠে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ড্রাইভার প্রশিক্ষণ সংস্থা জুতোবি (Zutobi) কর্তৃক পরিচালিত একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে। ৫৩টি দেশের উপর ভিত্তি করে করা এই গবেষণায় ভারত ৪৯তম স্থানে রয়েছে, যা তালিকার নিচের পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫১তম স্থানে থেকে তৃতীয় সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে, নরওয়ে টানা চতুর্থ বছর বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ড্রাইভিং দেশ হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে, আর দক্ষিণ আফ্রিকা টানা দ্বিতীয় বছর তালিকার একেবারে নিচে অবস্থান করছে।
জুতোবির এই প্রতিবেদনে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ এবং বিপজ্জনক ড্রাইভিং দেশ নির্ধারণের জন্য বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মোটরওয়ের গতিসীমা, চালকদের জন্য রক্তে অ্যালকোহলের ঘনত্বের সীমা এবং সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছরের তুলনায় সমস্ত দেশে গড়ে প্রতি ১,০০,০০০ জনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৮.৯ থেকে কমে ৬.৩-এ দাঁড়িয়েছে। তবে, জাতীয় গতিসীমা এবং রক্তে অ্যালকোহলের ঘনত্বের সীমায় কোনও পরিবর্তন হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকার সড়ক নিরাপত্তা: সমস্যা ও কারণ
দক্ষিণ আফ্রিকার সড়ক নিরাপত্তার অবস্থা উদ্বেগজনক। জুতোবির প্রতিবেদন অনুসারে, এই দেশে প্রতি ১,০০,০০০ জনে ২৪.৫ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান, যা বিশ্ব গড় (৬.৩) থেকে অনেক বেশি। এছাড়া, দেশটিতে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার খুবই কম—মাত্র ৩১% সামনের আসনের যাত্রী সিটবেল্ট পরেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৫৭.৫% ক্ষেত্রে অ্যালকোহল জড়িত। এই পরিসংখ্যান দক্ষিণ আফ্রিকাকে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ড্রাইভিং দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় গাড়ি পরীক্ষণ কেন্দ্রে যানবাহনের রোডওয়ার্দি লাইসেন্সিংয়ের কাজে নিয়োজিত আলিশা চিন্নাহ বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকায় আইন আছে, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত ট্রাফিক অফিসারদের ঘুষ নেওয়ার কারণে এই আইনের প্রয়োগে ঘাটতি রয়েছে। এটি চালকদের মধ্যে সাধারণ আলোচনার বিষয়।” তিনি আরও জানান, আইন প্রয়োগের অভাবে অনেক অযোগ্য চালক রাস্তায় গাড়ি চালাচ্ছেন, যা সড়ক দুর্ঘটনার হার বাড়িয়ে তুলছে।
ভারতের অবস্থান: ৪৯তম স্থানে কেন?
ভারত এই তালিকায় ৪৯তম স্থানে রয়েছে, যা নির্দেশ করে যে এখানেও সড়ক নিরাপত্তা একটি গুরুতর সমস্যা। জুতোবির প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে প্রতি ১,০০,০০০ জনে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর এই হার ছিল ১৫.৬, যা এ বছর ২২.৬-এ পৌঁছেছে—অর্থাৎ ৫০% বৃদ্ধি। এছাড়া, সিটবেল্ট ব্যবহারের হার এবং অ্যালকোহল-সম্পর্কিত দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানও ভারতের এই নিম্ন র্যাঙ্কিংয়ের জন্য দায়ী। ভারতের সড়ক অবকাঠামো, চালকদের আচরণ এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগে ঘাটতি এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে।
নরওয়ে: বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ড্রাইভিং দেশ
নরওয়ে টানা চতুর্থ বছর বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ড্রাইভিং দেশ হিসেবে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এই দেশে প্রতি ১,০০,০০০ জনে মাত্র ১.৪৮ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সিটবেল্ট ব্যবহারের হার ৯৭.৮% এবং অ্যালকোহল-সম্পর্কিত সড়ক মৃত্যু মাত্র ১৩%। নরওয়ের সরকার-প্রদত্ত বিশ্রামস্থল, শৌচাগার এবং দৃষ্টিনন্দন স্থানগুলো দুর্ঘটনার হার কমাতে সাহায্য করেছে। দেশটির কঠোর ট্রাফিক আইন এবং চালক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব এটিকে একটি আদর্শ উদাহরণ করে তুলেছে।
জুতোবির গবেষণা পদ্ধতি
জুতোবি ৫৩টি দেশের উপর ভিত্তি করে এই গবেষণা পরিচালনা করেছে। প্রতিটি দেশকে পাঁচটি সূচকের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে এবং প্রতিটি সূচকে ১০-এর মধ্যে একটি স্কোর দেওয়া হয়েছে। এরপর গড় স্কোরের ভিত্তিতে চূড়ান্ত র্যাঙ্কিং নির্ধারণ করা হয়েছে। সূচকগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার (প্রতি ১,০০,০০০ জনে)
- মোটরওয়ের সর্বোচ্চ গতিসীমা
- সামনের আসনে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার
- অ্যালকোহল-সম্পর্কিত সড়ক মৃত্যুর অনুপাত
- চালকদের জন্য রক্তে অ্যালকোহলের ঘনত্বের সীমা
এই তথ্যগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল হেলথ অবজার্ভেটরি ডাটাবেস থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে, সমালোচকরা বলছেন, এই গবেষণায় ১৯৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ৫৩টি দেশ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কেবল দক্ষিণ আফ্রিকা, মরিশাস এবং মরক্কোর তথ্য বিবেচনা করা হয়েছে। এটি গবেষণার পক্ষপাতিত্ব এবং সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করে।
দক্ষিণ আফ্রিকার তুলনায় অন্যান্য দেশ
তালিকায় দ্বিতীয় সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশ হিসেবে রয়েছে থাইল্যান্ড (২৫.৪ মৃত্যু প্রতি ১,০০,০০০ জনে), যেখানে সিটবেল্ট ব্যবহারের হার কম এবং মোটরবাইক প্রধান পরিবহন মাধ্যম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫১তম স্থানে রয়েছে, যেখানে ২৯% সড়ক মৃত্যু অ্যালকোহল-সম্পর্কিত। ভারতের পরে আর্জেন্টিনা (৫০তম) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিকার নিচের দিকে অবস্থান করছে।
সমাধানের পথ
জুতোবি জানিয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে চালকদের দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালানো, মনোযোগের অভাব, মদ্যপান করে গাড়ি চালানো এবং রাস্তার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে অবহেলা। সরকারি সচেতনতা প্রচারণা এবং কঠোর শিক্ষা এই সমস্যা মোকাবিলায় সাহায্য করতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্ষেত্রে, আইন প্রয়োগে দুর্নীতি দূর করা এবং সিটবেল্ট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা অত্যন্ত জরুরি।
দক্ষিণ আফ্রিকার সড়ক নিরাপত্তার অবস্থা উন্নত করতে জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন। ভারতের জন্যও এই জরিপ একটি সতর্কতা, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমশ বাড়ছে। নরওয়ের মতো দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে কঠোর আইন, সচেতনতা এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। জুতোবির এই প্রতিবেদন বিশ্বব্যাপী সড়ক নিরাপত্তার চিত্র তুলে ধরেছে এবং দেশগুলোকে তাদের দুর্বলতা চিহ্নিত করে সমাধানের পথে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।