পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও এক ধাপ তীব্র রূপ নিল বুধবার গভীর রাতে, যখন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের (Imran Khan) বোন এবং পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)–এর শত শত সমর্থক হঠাৎই রাওয়ালপিন্ডির আদিয়ালা জেলের সামনে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। অভিযোগ, টানা তিন সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে ইমরান খানকে কোনও পরিবারের সদস্যের সঙ্গেই দেখা করতে দেওয়া হয়নি। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করেই সরাসরি পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির এবং গোটা সামরিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেন পিটিআই সমর্থকরা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো এলাকা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, জেলের চারপাশে অস্বাভাবিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
পিটিআই চেয়ারম্যান ইমরান খানের বোন আলিয়া রিয়াজ খান মাঝরাতেই জেলের সামনে এসে পৌঁছন, আর তাঁর উপস্থিতিতেই বিক্ষোভের আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। তিনি বলেন, “আমার ভাইকে আমরা কেউ দেখতে পাচ্ছি না। তিন সপ্তাহ হয়ে গেল, কোনও সাক্ষাতের অনুমতি নেই। জেল প্রশাসন কিছুই জানাচ্ছে না। আমাদের পরিবারের ওপর এই নিষেধাজ্ঞা সম্পূর্ণ অমানবিক।” আলিয়া অভিযোগ করেন, ইমরান খানকে এমনভাবে আটকে রাখা হয়েছে যেন তিনি কোনও সাধারণ বন্দি নন, বরং একটি ‘বন্দিশিবিরে’ বন্দি। তাঁর কথায় স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল পরিবারের উদ্বেগ, ক্ষোভ আর অসহায়তা।
জেলের বাইরে তখন শত শত পিটিআই সমর্থক স্লোগান দিতে শুরু করেছেন—“রিলিজ ইমরান খান”, “স্টপ টর্চারিং আওয়ার লিডার”, “ডাউন উইথ আসিম মুনির”—এমন সব স্লোগানে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে গিয়েছে। প্ল্যাকার্ডে লেখা—Let Imran Meet His Family, End Munir’s Fascism, Stop State Brutality—সবই সেই ক্ষোভের প্রতিফলন। প্রতিটি মুহূর্তে বিক্ষোভ বাড়তে থাকায় পুলিশ অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করে এবং জেলের চারপাশে ব্যারিকেড তৈরি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে।
পিটিআইয়ের তরফে জানানো হয়েছে, ইমরান খানকে শুধু পরিবারের সঙ্গেই নয়, এমনকি নিয়মিত আইনজীবীদের সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হচ্ছে না। সাধারণ ‘মিটিং ডে’-তেও হঠাৎ করে সাক্ষাৎ বাতিল করা হচ্ছে এবং কোনও ব্যাখ্যাই দেওয়া হচ্ছে না। পিটিআইয়ের দাবি, এগুলো সবই জেনারেল আসিম মুনিরের নির্দেশ। উদ্দেশ্য হল ইমরান খানকে “মানসিকভাবে ভেঙে ফেলা”। দলের অভিযোগ, ইমরান খানের নিরাপত্তা, খাবার, ওষুধ—সব কিছুর ওপর নজিরবিহীন বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এই ঘটনার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই পাকিস্তানজুড়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে নানা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। “#LetImranMeetFamily”, “#FreeImranKhan”, “#StopMunirFascism”—এই হ্যাশট্যাগগুলি রাতারাতি ট্রেন্ডিং তালিকার শীর্ষে উঠে আসে। অনেকে পোস্ট করেন, পাকিস্তানে এখন গণতন্ত্র নয়, বরং “এক ব্যক্তির শাসনে রাষ্ট্র চলছে”—এমন মন্তব্য করেও তীব্র সমালোচনা করেন সামরিক নেতৃত্বকে। প্রবাসী পাকিস্তানিরাও এই ঘটনার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
পিটিআইয়ের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য আরও সরাসরি। তাঁদের দাবি, জেনারেল মুনির জানেন যে ইমরান খান যদি মুক্ত হন, তাহলে তিনি ফের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠবেন এবং জনগণ তাঁকেই ক্ষমতায় দেখতে চাইবে। তাই তাঁকে বন্দি করে রেখে রাজনৈতিকভাবে অক্ষম করার চেষ্টা চলছে। ইমরানের আইনজীবী ইন্তেখাব চৌধুরী বলেন, “এটা আইনত বেআইনি। সাক্ষাৎ বন্ধ করার কোনও আইনি ভিত্তি নেই। এটা সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা।” তাঁর মতে, মামলা বিচারাধীন হলেও পরিবারকে দেখা করতে দেওয়া বাধ্যতামূলক, কিন্তু প্রশাসন আইনকে তোয়াক্কা না করেই চলেছে।
অন্যদিকে জেল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ইমরান খানের ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ নিরাপত্তা পরিস্থিতি’ বিবেচনা করেই সাক্ষাৎ সীমিত করা হয়েছে। যদিও পিটিআই এই ব্যাখ্যাকে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তাদের মতে, এটি কেবলই রাজনৈতিক মোকাবিলা, যেখানে আইন, মানবাধিকার বা ন্যায্যতার কোনও স্থান নেই।
রাতভর বিক্ষোভের পর পিটিআই ঘোষণা করেছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যদি ইমরান খানকে পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি না দেওয়া হয়, তাহলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ শুরু হবে। রাওয়ালপিন্ডিতে বড় মিছিলের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার কাছেও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানো হবে বলে দল জানিয়েছে।
সব মিলিয়ে ঘটনাটি পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করেছে। ইমরান খান বহু মামলায় বন্দি থাকলেও তাঁকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার অভিযোগ দেশে নতুন উত্তেজনা তৈরি করেছে। সেনা ও পিটিআইয়ের মধ্যকার দ্বন্দ্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশের রাজনীতি এখন অনিশ্চয়তার অন্ধকারে প্রবেশ করেছে। অনেকের মতে, আদিয়ালা জেলের সামনে ইমরানের বোনের কান্না আর সমর্থকদের স্লোগান আজ পাকিস্তানের বাস্তব ছবি—যেখানে গণতন্ত্র লড়ছে রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরুদ্ধে।
