কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের সারে শহরে শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে (Hindu Temple) খালিস্তানপন্থী গ্রাফিতি দিয়ে ভাঙচুরের ঘটনায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষের বিবৃতি অনুসারে, এই ঘটনা ১৯ এপ্রিল, ২০২৫-এর ভোররাত প্রায় ৩টায় সংঘটিত হয়েছে। দুজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সাইনবোর্ড এবং স্তম্ভগুলোতে ‘খালিস্তান’ শব্দটি স্প্রে-পেইন্টের মাধ্যমে লিখে ভাঙচুর করেছে। এছাড়া, এই ঘটনার সময় মন্দিরের নিরাপত্তা ক্যামেরাও চুরি হয়েছে।
মন্দির কর্তৃপক্ষ তাদের বিবৃতিতে এই ঘটনাকে ‘ঘৃণাপ্রসূত ভাঙচুর এবং চুরি’ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছে, “এটি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং একটি পবিত্র স্থানের উপর সরাসরি আক্রমণ, যা অনেক পরিবার, বয়স্ক ব্যক্তি এবং শিশুদের জন্য আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে।” তারা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং জনসাধারণ ও সরকারের সকল স্তরের নেতাদের এই ঘৃণামূলক অপরাধের নিন্দা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সারে পুলিশের কাছে একটি এফআইআর (প্রথম তথ্য প্রতিবেদন) দায়ের করা হয়েছে, এবং তারা তদন্তে পূর্ণ সহযোগিতা করছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা কানাডার সম্মানজনক এবং বৈচিত্র্যময় সমাজে উপাসনালয়ের উপর এই ধরনের আক্রমণের কোনো স্থান নেই বলে মনে করি।”
কানাডিয়ান সাংবাদিক ড্যানিয়েল বোর্ডম্যান জানিয়েছেন, এটি শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে তৃতীয়বারের মতো ভাঙচুরের ঘটনা। তিনি এক্স-এ পোস্ট করা একটি ভিডিওতে বলেছেন, “আমি যখন সেখানে পৌঁছাই, তখন দেখি গ্রাফিতিগুলো ইতিমধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে, তবে কিছু ভাঙা কাচ এখনও ছিল। সকালে রেকর্ড করা ভিডিওতে দেখা গেছে, খালিস্তানপন্থীরা এর পিছনে রয়েছে।” তিনি আরও জানান, ভাঙচুরের সময় দুজন ব্যক্তি মন্দিরের দেয়ালে গ্রাফিতি করেছে এবং একটি নিরাপত্তা ক্যামেরা চুরি করেছে। বোর্ডম্যান মন্দির পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কথা বলে জানান, ভক্তরা এই ঘটনায় ব্যথিত এবং তারা মনে করেন না যে পুলিশ বা রাজনৈতিক নেতারা এই বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এই ঘটনা কানাডায় হিন্দু মন্দিরগুলোর উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের একটি অংশ। গত কয়েক বছরে, সারে এবং অন্যান্য অঞ্চলে একাধিক হিন্দু মন্দির খালিস্তানপন্থী গ্রাফিতি এবং ভাঙচুরের শিকার হয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্টে, শ্রী লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরে খালিস্তান রেফারেন্ডাম পোস্টার লাগানো হয়েছিল, যাতে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। একই বছর সেপ্টেম্বরে, সারের শ্রী মাতা ভামেশ্বরী দুর্গা সোসাইটি মন্দিরে ‘পাঞ্জাব ভারত নয়’ এবং ‘মোদী সন্ত্রাসী’ লেখা গ্রাফিতি করা হয়। এই ঘটনাগুলো কানাডায় খালিস্তানপন্থী উগ্রবাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের ইঙ্গিত দেয়।
কানাডার ভারতীয় বংশোদ্ভূত সাংসদ চন্দ্র আর্য এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, “হিন্দু মন্দিরগুলোর উপর আক্রমণ কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছিল এবং আজও অব্যাহত রয়েছে। এই সাম্প্রতিক গ্রাফিতি খালিস্তানি উগ্রবাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের আরেকটি ভয়ঙ্কর স্মারক।” তিনি হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়কে একত্রিত হয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তাৎক্ষণিক ও কঠোর পদক্ষেপ দাবি করার আহ্বান জানিয়েছেন। আর্য আরও জানান, একই দিনে ভ্যাঙ্কুভারের রস স্ট্রিট গুরুদ্বারা, যিনি খালসা দিওয়ান সোসাইটি দ্বারা পরিচালিত, সেখানেও খালিস্তানপন্থী গ্রাফিতি দিয়ে ভাঙচুর করা হয়েছে।
খালসা দিওয়ান সোসাইটি তাদের বিবৃতিতে বলেছে, “এই ভাঙচুর খালিস্তানের পক্ষে উকিল একটি ক্ষুদ্র শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কাজ। এটি কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে ভয় ও বিভাজন সৃষ্টির একটি চলমান প্রচারণার অংশ।” তারা এই কাজকে শিখ ধর্ম এবং কানাডীয় সমাজের অন্তর্ভুক্তি, সম্মান এবং পারস্পরিক সমর্থনের মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে নিন্দা করেছে।
কানাডায় হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের উপর এই ধরনের আক্রমণ নতুন নয়। ভারত বারবার কানাডার সরকারের কাছে খালিস্তানপন্থী উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এর আগে বলেছেন, কানাডার মতো দেশগুলোর উচিত উগ্র খালিস্তানি মতাদর্শকে প্ল্যাটফর্ম না দেওয়া, কারণ এটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর।
কানাডীয় হিন্দু চেম্বার অফ কমার্স এই ঘটনাকে ‘হিন্দু-বিদ্বেষমূলক’ কাজ হিসেবে বর্ণনা করে সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছে। তারা এক্স-এ লিখেছে, “আমরা খালিস্তানি উগ্রবাদীদের দ্বারা লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরের ভাঙচুরের তীব্র নিন্দা জানাই। কানাডায় এই ধরনের ঘৃণার কোনো স্থান নেই।”
এই ঘটনা কানাডার বৈচিত্র্যময় সমাজে ধর্মীয় স্থানের নিরাপত্তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। স্থানীয় পুলিশ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে, এবং মন্দির কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা এই ঘটনার পর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করবে। হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায় এখন একত্রিত হয়ে এই ধরনের ঘৃণামূলক কাজের বিরুদ্ধে কণ্ঠস্বর উত্তোলন করছে, এবং তারা আশা করছে যে কর্তৃপক্ষ দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। এই ঘটনা কানাডায় ধর্মীয় সহনশীলতা এবং সম্প্রীতির গুরুত্ব পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।