পাকিস্তানে (Pakistan) আবারও সামরিক ক্ষমতার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। বুধবার দেশটির সংসদে পাস হয়েছে এক ঐতিহাসিক কিন্তু বিতর্কিত সংবিধান সংশোধনী, যার মাধ্যমে সেনাপ্রধান সৈয়দ আসিম মুনির পেলেন আজীবন আইনি দায়মুক্তি এবং দেশের তিন বাহিনীর ওপর সর্বময় কর্তৃত্ব।
এই সংশোধনীর ফলে এখন থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান শুধু আর্মির নয়, ‘চিফ অফ ডিফেন্স ফোর্সেস’ হিসেবে নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীরও সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকবেন। সংসদের নিম্নকক্ষে ২৩৪ জন সাংসদ এই সংশোধনীর পক্ষে ভোট দেন, মাত্র চারজন বিরোধিতা করেন।
এই ঘটনাকে বিশ্লেষকরা বলছেন — পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির অধ্যায়।
⚖️ আজীবন আইনি দায়মুক্তি, ক্ষমতা এক ব্যক্তির হাতে
নতুন সংবিধান সংশোধনীর আওতায় শুধু সেনাপ্রধানই নয়, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও আজীবন আইনি সুরক্ষা পাবেন। অর্থাৎ ভবিষ্যতে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে অভিযোগ বা মামলা করা যাবে না। এই দায়মুক্তি নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও বিচার বিভাগীয় মহলে।
করাচি-ভিত্তিক আইনজীবী সালাহউদ্দিন আহমেদ মন্তব্য করেছেন, “নতুন সংবিধান সংশোধনী স্বাধীন বিচারব্যবস্থার মৃত্যু ঘটাবে। এখন থেকে ‘ক্রনি জাজ’ বা সরকারের অনুগত বিচারপতিরাই রাষ্ট্রের সব সিদ্ধান্তকে অনুমোদন দেবেন।”
নতুন সংবিধান অনুসারে একটি নতুন আদালত গঠিত হবে, যা বর্তমান সুপ্রিম কোর্টের উপরে অবস্থান করবে এবং রাজনৈতিক ও সামরিক সিদ্ধান্তের ওপর চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখবে।
🪖 সামরিক প্রভাবের ইতিহাসে নতুন মোড়
পাকিস্তান তার জন্মলগ্ন থেকেই সামরিক প্রভাবের মধ্যে আবদ্ধ। স্বাধীনতার পর থেকে দেশটি বারবার সামরিক অভ্যুত্থান ও সেনাশাসনের মধ্য দিয়ে গেছে। সর্বশেষ সামরিক শাসক ছিলেন পারভেজ মুশাররফ, যিনি ১৯৯৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে ২০০৮ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন।
তাঁর পর থেকে যদিও বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় আসে, তবু রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান প্রকৃত অর্থে ‘হাইব্রিড রেজিম’—অর্থাৎ একসঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক শাসনের মিশ্রণ।
নতুন ২৭তম সংবিধান সংশোধনী সেই ভারসাম্যকে পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে। এখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কার্যত সংবিধানগতভাবে দেশের রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পেয়ে গেল।
🗣️ “এটি সামরিক শাসনের নতুন রূপ”
পাকিস্তানি সামরিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, “এই পরিবর্তন কোনো সরাসরি সামরিক শাসন নয়, কিন্তু এর প্রভাব আরও গভীর। এখন থেকে পাকিস্তান কার্যত সেনা শাসিত রাষ্ট্র।”
তিনি আরও বলেন, “ফিল্ড মার্শাল মুনির এখন কেবল আর্মির নয়, পুরো দেশের সামরিক কাঠামোর কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর অধীনে এখন সব সিদ্ধান্ত একত্রীভূত হবে।”
🧱 আদালতের স্বাধীনতা সংকটে
সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের পদোন্নতি, বদলি ও অপসারণের ক্ষমতাও রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও সেনাবাহিনীর হাতে চলে গেছে। কোনো বিচারপতি যদি রাজনৈতিকভাবে নির্ধারিত বদলি প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হবে।
পাকিস্তানের আইনজীবী মহল এই বিধানকে “বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতার চূড়ান্ত পতন” বলে মন্তব্য করেছে।
করাচির আইনজীবী সাদ রাসুল বলেছেন, “এটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার জন্য শেষ পেরেক। আদালত এখন শুধুই সামরিক ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অনুমোদন কেন্দ্র।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও বিরোধী শূন্যতা
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান-এর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (PTI) এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করেছে, কিন্তু তাদের অধিকাংশ সাংসদ জেলে বন্দি থাকায় ভোটে অংশ নিতে পারেননি। তাই সংসদে কার্যত কোনো বিরোধিতা ছাড়াই সংশোধনীটি পাস হয়ে যায়।
ইমরান খান বর্তমানে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। তাঁর দল দাবি করছে, “এটি সামরিক বাহিনীর প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ।”
দেশজুড়ে প্রতিবাদ নিষিদ্ধ, গণমাধ্যমে সেনা-বিরোধী প্রতিবেদন প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা, আর সাংবাদিকদের ওপর ক্রমবর্ধমান চাপ—সব মিলিয়ে পাকিস্তানের গণতন্ত্র আজ গভীর সংকটে।
🧭 সমর্থকদের যুক্তি
সরকার ও সেনা সমর্থকদের মতে, এই পরিবর্তন দেশকে আধুনিক যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসবিরোধী প্রস্তুতির জন্য উপযোগী করবে। সাম্প্রতিক ভারত-পাক সংঘাত ও সীমান্ত উত্তেজনা এই পরিবর্তনের অন্যতম কারণ বলে তারা দাবি করেছে।
ইসলামাবাদভিত্তিক বিশ্লেষক কামার চীমা বলেছেন, “যুদ্ধের ধরন বদলে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর মধ্যে ঐক্য ও দক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি।”
🌍 আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
নতুন পদমর্যাদা পাওয়ার পর থেকেই ফিল্ড মার্শাল মুনিরের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। গত জুনে ও সেপ্টেম্বরে দু’বার তিনি হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে প্রতিরক্ষা ও খনিজ সহযোগিতা গড়ে উঠছে বলে জানা গেছে।
তবে সমালোচকদের মতে, মুনিরের এই অবস্থান পাকিস্তানকে আরও আন্তর্জাতিকভাবে নির্ভরশীল করে তুলবে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক ভারসাম্য আরও দুর্বল করবে।
একটি পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র যেখানে ২৪ কোটি মানুষ বাস করে, সেখানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা এতটা কেন্দ্রীভূত হওয়া নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ভারসাম্যে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। কেউ বলছেন “রাষ্ট্র রক্ষার প্রস্তুতি”, কেউ বলছেন “গণতন্ত্রের সমাধি”।
কিন্তু ইতিহাস বলে, পাকিস্তানে যখনই সেনাবাহিনী অতি শক্তিশালী হয়েছে, তখনই জনগণের কণ্ঠস্বর সবচেয়ে ক্ষীণ হয়েছে। নতুন সংবিধান সংশোধনী সেই ইতিহাসের আরেকটি অধ্যায় মাত্র।


