পাকিস্তানের (Pakistan) অশান্ত বালুচিস্তান প্রদেশে মঙ্গলবার সন্দেহভাজন জঙ্গিরা একটি যাত্রীবাহী ট্রেন হাইজ্যাক করার পর নিরাপত্তা বাহিনী ৮০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করেছে বলে সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন। জাফর এক্সপ্রেস নামের এই ট্রেনটি কোয়েটা থেকে পেশোয়ারের উদ্দেশে যাত্রা করছিল। ট্রেনে প্রায় ৫০০ যাত্রী ছিলেন, এবং এটি নয়টি বগি নিয়ে গঠিত। গুদালার এবং পিরু কুনরির কাছে পাহাড়ি এলাকার একটি সুড়ঙ্গে ট্রেনটি প্রবেশ করার সময় সশস্ত্র ব্যক্তিরা এটিকে আটকে দেয়।
জঙ্গিরা ট্রেনের উপর গুলি চালায়, যার ফলে বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়। তারা দাবি করে যে তারা ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে জিম্মি করেছে। বালুচিস্তান সরকারের মুখপাত্র শহিদ রিন্দ জানিয়েছেন, “নিরাপত্তা বাহিনী একটি বগি থেকে ৮০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। এদের মধ্যে ৪৩ জন পুরুষ, ২৬ জন মহিলা এবং ১১ জন শিশু রয়েছে।” তবে, প্রায় ৪০০ যাত্রী এখনও ট্রেনের ভিতরে আটকা পড়ে আছেন। সুড়ঙ্গের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গিদের মধ্যে তীব্র গোলাগুলি চলছে।
শহিদ রিন্দ আরও বলেন, “পেশোয়ারগামী এই ট্রেনে ‘তীব্র’ গুলির খবর পাওয়া গেছে। উদ্ধারকারী দল ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে।” এদিকে, পাকিস্তান রেলওয়ে কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশনে একটি জরুরি ডেস্ক স্থাপন করেছে। আতঙ্কিত আত্মীয়রা তাদের প্রিয়জনদের সম্পর্কে খবর জানতে সেখানে ভিড় করছেন। এখনও কোনও হতাহত বা আহতের সরকারি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। তবে একজন জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন যে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়েছে।
ঘটনার প্রেক্ষাপট
কোয়েটা এবং পেশোয়ারের মধ্যে ট্রেন পরিষেবা সম্প্রতি দেড় মাসের স্থগিতাদেশের পর পুনরায় চালু হয়েছিল। গত নভেম্বরে কোয়েটা রেলওয়ে স্টেশনে একটি আত্মঘাতী বোমা হামলায় ২৬ জন নিহত এবং ৬২ জন আহত হয়েছিল। এর ফলে বেশ কয়েকটি ট্রেন পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর বালুচিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
এলাকার জেলা পুলিশ অফিসার রানা মুহাম্মদ দিলওয়ার জানিয়েছেন, “নিরাপত্তা বাহিনী ঘটনাস্থল ঘিরে ফেলেছে। জঙ্গিরা কিছু মহিলা ও শিশুকে জিম্মি করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।” তিনি আরও জানান, ট্রেনে চার থেকে পাঁচজন সরকারি কর্মকর্তাও ছিলেন। পেশোয়ার রেলওয়ে স্টেশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা তারিক মাহমুদ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অপ্রমাণিত গুজবের উপর ভিত্তি করে কিছু না বিশ্বাস করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
উদ্ধার অভিযান ও চ্যালেঞ্জ
শহিদ রিন্দ জানিয়েছেন, সিবি হাসপাতালে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। চিকিৎসা কর্মীরা প্রস্তুত রয়েছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন যে দুর্গম ভূখণ্ডের কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাহাড়ি এলাকা এবং সুড়ঙ্গের অবস্থান উদ্ধার অভিযানকে জটিল করে তুলেছে। নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গিদের মধ্যে চলমান গোলাগুলি পরিস্থিতিকে আরও বিপজ্জনক করে তুলেছে।
পাকিস্তানের এই অশান্ত প্রদেশে জঙ্গি হামলা নতুন কিছু নয়। বালুচিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) নামে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী এই অঞ্চলে সরকারি বাহিনী এবং অবকাঠামোর উপর বারবার হামলা চালিয়ে আসছে। তারা দাবি করে যে পাকিস্তান সরকার বালুচিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের শোষণ করছে, কিন্তু স্থানীয় জনগণের উন্নয়নের জন্য কিছুই করছে না।
বালুচিস্তানের অস্থিরতা
বালুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ হলেও এটি জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে কম ঘনত্বপূর্ণ। তেল এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীগুলি বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। সম্প্রতি চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পের কারণে এই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বেড়েছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেন যে এই প্রকল্পগুলি তাদের পরিবেশের ক্ষতি করছে এবং তাদের বাস্তুচ্যুত করছে।
গত বছর বালুচিস্তানে ১৫০টিরও বেশি হামলা হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ইসলামাবাদ-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা পাক ইনস্টিটিউট অফ পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) জানিয়েছে। এই হামলাগুলির মধ্যে সরকারি বাহিনী, রেললাইন এবং চীনা প্রকল্পগুলি প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে।
জঙ্গিদের দাবি ও হুমকি
বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) এই হামলার দায় স্বীকার করেছে। তারা দাবি করেছে যে তারা ট্রেনে থাকা সামরিক কর্মীদের জিম্মি করেছে এবং বেসামরিক যাত্রীদের, বিশেষ করে মহিলা, শিশু এবং বেলুচ নাগরিকদের মুক্তি দিয়েছে। বিএলএ মুখপাত্র জিয়ান্দ বেলুচ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “যদি পাকিস্তানি বাহিনী কোনও সামরিক অভিযান চালায়, তবে সমস্ত জিম্মিকে হত্যা করা হবে।” তারা বেলুচ রাজনৈতিক বন্দী এবং জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের মুক্তির দাবি জানিয়েছে।
বিএলএ-এর দাবি অনুযায়ী, তারা ৩০ জনেরও বেশি পাকিস্তানি সামরিক কর্মীকে হত্যা করেছে। তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এই দাবি নাকচ করে দিয়েছে। পুলিশের দাবি, প্রায় ৩৫০ যাত্রী নিরাপদে রয়েছেন এবং জিম্মি সংখ্যা বিএলএ-এর দাবির তুলনায় অনেক কম।
পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি
নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, তারা জঙ্গিদের ঘিরে ফেলেছে। তবে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান এবং দুর্বল নেটওয়ার্ক কভারেজের কারণে যোগাযোগ স্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। রেলওয়ে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ট্রেনের ৪৫০ যাত্রী এবং কর্মীদের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ স্থাপন করা যায়নি। একটি ত্রাণ ট্রেন সৈন্য এবং চিকিৎসকদের নিয়ে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা দিয়েছে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নকভি এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, “যারা নিরীহ যাত্রীদের উপর গুলি চালায়, তাদের কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।” তিনি জঙ্গিদের ‘পশু’ আখ্যা দিয়ে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েছেন।
বালুচিস্তানে জাফর এক্সপ্রেসের হাইজ্যাক পাকিস্তানের নিরাপত্তা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতা তুলে ধরেছে। ৮০ জন যাত্রীর উদ্ধার স্বস্তি এনেছে, তবে শত শত মানুষ এখনও সুড়ঙ্গে আটকা রয়েছেন। নিরাপত্তা বাহিনী এবং জঙ্গিদের মধ্যে চলমান সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে আরও উত্তেজনাপূর্ণ করে তুলেছে। এই ঘটনা বালুচিস্তানের দীর্ঘদিনের অস্থিরতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের প্রতিফলন। আগামী কয়েক ঘণ্টা এই সংকটের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হবে। পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ বাড়ছে যাতে তারা জিম্মিদের নিরাপদে উদ্ধার করতে পারে এবং এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।