North Sea Ship Collision: উত্তর সাগরে মার্কিন সেনার তেল ট্যাঙ্কার-জাহাজের সংঘর্ষে বিস্ফোরণ

উত্তর সাগরে (North Sea) একটি মার্কিন তেল ট্যাঙ্কার এবং একটি পর্তুগিজ কন্টেইনার জাহাজের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের (North Sea Ship Collision) ঘটনায় দুটি জাহাজই আগুনে জ্বলছে।…

North Sea Ship Collision

উত্তর সাগরে (North Sea) একটি মার্কিন তেল ট্যাঙ্কার এবং একটি পর্তুগিজ কন্টেইনার জাহাজের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের (North Sea Ship Collision) ঘটনায় দুটি জাহাজই আগুনে জ্বলছে। এই দুর্ঘটনায় একজন নাবিক নিখোঁজ রয়েছেন, এবং পরিবেশ দূষণের গুরুতর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সোমবার সকালে ইংল্যান্ডের পূর্ব ইয়র্কশায়ার উপকূল থেকে প্রায় ১৩ মাইল দূরে এই ঘটনা ঘটে। জাহাজ দুটি হলো মার্কিন পতাকাবাহী তেল ট্যাঙ্কার ‘স্টেনা ইম্যাকুলেট’ এবং পর্তুগিজ পতাকাবাহী কন্টেইনার জাহাজ ‘সোলং’। এই সংঘর্ষের পর থেকে উদ্ধারকার্য চলছে, এবং পরিবেশবিদরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

সংঘর্ষের বিবরণ
স্থানীয় সময় সকাল ৯:৪৮ মিনিটে প্রথম সতর্কতা জারি করা হয়। এইচএম কোস্টগার্ড জানিয়েছে, সংঘর্ষের প্রায় ৩০ মিনিট পরে, সকাল ১০:২০ মিনিটে, উদ্ধারকার্যের জন্য একাধিক লাইফবোট মোতায়েন করা হয়। মেরিন ট্র্যাকিং ডেটা থেকে জানা গেছে, স্টেনা ইম্যাকুলেট তখন স্থির অবস্থায় নোঙর করা ছিল, আর সোলং জাহাজটি উত্তর দিক থেকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছিল। সংঘর্ষের পর দুটি জাহাজেই আগুন ধরে যায় এবং একাধিক বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ছবি ও ভিডিওতে দেখা গেছে, জাহাজ দুটি থেকে কালো ধোঁয়ার বিশাল মেঘ আকাশে উঠছে।

   

স্টেনা ইম্যাকুলেট জাহাজটি জেট এ-১ জ্বালানি বহন করছিল, যা মার্কিন সামরিক বাহিনীর জন্য পরিবহন করা হচ্ছিল। সংঘর্ষের ফলে জাহাজের একটি কার্গো ট্যাঙ্ক ফেটে যায়, এবং জ্বালানি সমুদ্রে ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, সোলং জাহাজটি ১৫টি কন্টেইনারে অত্যন্ত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ‘সোডিয়াম সায়ানাইড’ বহন করছিল। এই পদার্থ পানির সংস্পর্শে এলে হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাসে রূপান্তরিত হয়, যা মানুষ ও জীবজগতের জন্য মারাত্মক বিপজ্জনক।

উদ্ধার ও হতাহতের খবর
দুর্ঘটনার পর জাহাজের নাবিকরা জাহাজ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। রয়্যাল ন্যাশনাল লাইফবোট ইনস্টিটিউশন (আরএনএলআই) জানিয়েছে, দুটি জাহাজ থেকে লোকজন জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ৩৬ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। ইস্ট মিডল্যান্ডস অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের তত্ত্বাবধানে তাদের শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করা হয়েছে, এবং তাদের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়নি। তবে, সোলং জাহাজের ১৪ জন নাবিকের মধ্যে একজন এখনও নিখোঁজ। জাহাজটির মালিক, হামবুর্গ-ভিত্তিক আর্নস্ট রাস, এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “১৩ জন নাবিককে নিরাপদে উপকূলে আনা হয়েছে। নিখোঁজ নাবিককে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।”

পরিবেশগত আশঙ্কা
এই দুর্ঘটনা উত্তর সাগরের পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জেট জ্বালানি এবং সম্ভাব্য সোডিয়াম সায়ানাইডের ফলে সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র প্রভাষক ও সামুদ্রিক পরিবেশবিদ ড. টম ওয়েব বলেন, “ইয়র্কশায়ার উপকূল এবং হাম্বার এস্টুয়ারির জীববৈচিত্র্য জৈবিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ে অভিবাসী পাখি এবং জলচর প্রাণীরা এখানে ভিড় করে। রাসায়নিক দূষণ পাখিদের সরাসরি ক্ষতি করতে পারে এবং সামুদ্রিক খাদ্য শৃঙ্খলের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। আমরা আশা করি, দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে দূষণ কমানো সম্ভব হবে।”

গ্রিনপিস ইউকে জানিয়েছে, এখনও পরিবেশগত ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে, তারা এই ঘটনার গতিবিধি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে ধোঁয়াশা
কীভাবে এই সংঘর্ষ ঘটল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। গ্রিমসবি পোর্টের প্রধান নির্বাহী মার্টিন বয়ার্স বলেন, “আধুনিক জাহাজে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরেও এমন দুর্ঘটনা রহস্যজনক। অটোপাইলট এই ঘটনার জন্য দায়ী হতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “রাডারে অন্য জাহাজের উপস্থিতি ধরা পড়ার কথা ছিল। কীভাবে এটি এড়ানো গেল না, তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।” মেরিন অ্যাকসিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্রাঞ্চ (এমএআইবি) এই ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে।

একজন বিশেষজ্ঞ স্কাই নিউজকে বলেন, দুর্ঘটনার সময় কুয়াশার কারণে দৃষ্টিসীমা কম থাকতে পারে, যা এই সংঘর্ষের একটি কারণ হতে পারে। তবে, রাডার ও অন্যান্য নেভিগেশন সরঞ্জাম ব্যবহার করে এটি এড়ানো সম্ভব ছিল।

Advertisements

স্টেনা ইম্যাকুলেটের বিশেষ ভূমিকা
স্টেনা ইম্যাকুলেট মার্কিন সরকারের ‘ট্যাঙ্কার সিকিউরিটি প্রোগ্রাম’-এর অংশ। এই প্রোগ্রামের আওতায় ১০টি ট্যাঙ্কার যুদ্ধ বা জাতীয় জরুরি অবস্থায় মার্কিন সামরিক বাহিনীকে জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রস্তুত থাকে। জাহাজটি গ্রিসের আগিওই থিওডোরোই থেকে যাত্রা করে ইংল্যান্ডের কিলিংহোমে পৌঁছানোর কথা ছিল। ক্রাউলি মেরিটাইম, যারা এই জাহাজটি পরিচালনা করে, জানিয়েছে, “আমাদের প্রথম অগ্রাধিকার মানুষের নিরাপত্তা ও পরিবেশ রক্ষা। আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে ও জাহাজ সুরক্ষিত করতে সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছি।”

উদ্ধারকার্য ও জরুরি প্রতিক্রিয়া
হাম্বার কোস্টগার্ডের একটি জরুরি কল থেকে জানা গেছে, সংঘর্ষের পরপরই উদ্ধার অভিযান শুরু হয়। হাম্বারসাইড থেকে একটি উদ্ধার হেলিকপ্টার, স্কেগনেস, ব্রিডলিংটন, ম্যাবলথর্প এবং ক্লিথোর্পস থেকে লাইফবোট এবং আগুন নেভানোর সরঞ্জামসহ নিকটবর্তী জাহাজ মোতায়েন করা হয়। কোস্টগার্ড জানিয়েছে, “এই ঘটনা এখনও চলমান। দূষণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে।”

রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ইউকে’র পরিবহণ সচিব হেইডি আলেকজান্ডার বলেন, “এই সংঘর্ষের খবরে আমি উদ্বিগ্ন। আমি কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।” স্থানীয় সাংসদ গ্রাহাম স্টুয়ার্ট জানান, একজন হাসপাতালে ভর্তি হলেও বাকি ৩৬ জন নাবিক নিরাপদে উপকূলে পৌঁছেছেন।

এই সংঘর্ষ উত্তর সাগরে নৌ নিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। একদিকে বিষাক্ত সোডিয়াম সায়ানাইড, অন্যদিকে জেট জ্বালানির ফলে পরিবেশগত ক্ষতির আশঙ্কা তীব্র। তদন্তে কী বেরিয়ে আসে এবং কীভাবে এই সংকট মোকাবিলা করা হয়, তা আগামী দিনে স্পষ্ট হবে। এই মুহূর্তে, নিখোঁজ নাবিকের জন্য প্রার্থনা এবং উদ্ধারকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই করার নেই।