মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌ সেনার সলিল সমাধি হবে এমনই কঠোর অবস্থান নিলেন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট (Nicolas Maduro) নিকোলাস মাদুরো। তিনি বিপুল সেনা বাহিনী ও জনতার ব্যারিকেড তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মাদক সাম্রাজ্য চালানোর অভিযোগ এনে সামরিক অভিযানের নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
ট্রাম্পের মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ ভেনেজুয়েলার জলসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে জানাচ্ছে আল জাজিরা। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ট্রাম্প প্রশাসন ভেনেজুয়েলার বামপন্থী প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর বিরুদ্ধে কোকেন পাচারের অভিযোগ তুলেছে এবং দাবি করেছে যে তিনি মাদকচক্রের সঙ্গে যুক্ত। ৭ আগস্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও বিচার বিভাগ মাদুরোর গ্রেফতারে তথ্যদাতার জন্য পুরস্কার দ্বিগুণ করে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘোষণা করে, তাকে “বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাদক পাচারকারী” বলে অভিহিত করে।
এর জবাবে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরো লক্ষ লক্ষ ভেনেজুয়েলাবাসীকে মিলিশিয়ায় যোগ দিতে আহ্বান জানিয়ে বলেন, “কোনো সাম্রাজ্য ভেনেজুয়েলার পবিত্র ভূমিকে স্পর্শ করতে পারবে না।” ভেনেজুয়েলার সরকার ঘোষণা করে যে তারা কলম্বিয়া সীমান্তে ১৫,০০০ সৈন্য মোতায়েন করছে মাদক পাচার মোকাবিলায়, ট্রাম্প প্রশাসনের চাপ রোখার অংশ হিসেবে।
কেন মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলো ভেনেজুয়েলার দিকে যাচ্ছে?
ট্রাম্প প্রশাসন দক্ষিণ ক্যারিবিয়ানে নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে, এই যুক্তিতে যে এটি মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠা অঞ্চলগুলোর “নার্কো-সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো”র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অংশ।
নিউ ইয়র্ক টাইমস গত মাসে রিপোর্ট করে যে ট্রাম্প একটি গোপন নির্দেশে পেন্টাগনকে কিছু লাতিন আমেরিকান মাদকচক্রের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন। সোমবার, রয়টার্স জানিয়েছে, অতিরিক্ত মার্কিন নৌজাহাজ দক্ষিণ ক্যারিবিয়ানে পাঠানো হয়েছে। গোপন সূত্র জানায়, ‘USS Lake Erie’ (একটি গাইডেড মিসাইল ক্রুজার) এবং ‘USS Newport News’ (একটি পারমাণবিক চালিত দ্রুত আক্রমণকারী সাবমেরিন) অঞ্চলটিতে আগামী সপ্তাহের শুরুতে পৌঁছাবে।
এর আগে, একাধিক সংবাদ সংস্থা রিপোর্ট করে যে তিনটি মার্কিন মিসাইল ধ্বংসকারী জাহাজ ভেনেজুয়েলার জলসীমার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রয়টার্সকে দেওয়া সূত্র জানায়, USS San Antonio, USS Iwo Jima এবং USS Fort Lauderdale জাহাজগুলো ৪,৫০০ মার্কিন সৈন্য বহন করছে, যার মধ্যে ২,২০০ মেরিন সেনা রয়েছে।
১৪ আগস্ট, ইউএস ফ্লিট ফোর্সেস কমান্ড এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায় যে Iwo Jima Amphibious Ready Group-এর নাবিক ও মেরিনরা ভার্জিনিয়া এবং নর্থ ক্যারোলিনা থেকে রওনা দিয়েছে। তবে বিজ্ঞপ্তিতে মিশনের বিস্তারিত তথ্য বা অবস্থান স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি।
হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিটকে ১৯ আগস্ট সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেন, যুক্তরাষ্ট্র ভেনেজুয়েলায় স্থলবাহিনী পাঠাতে পারে কি না। তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প খুব স্পষ্ট ও দৃঢ়—আমেরিকার শক্তির প্রতিটি উপাদান ব্যবহার করতে তিনি প্রস্তুত, যাতে মাদক দেশে ঢোকার পথ বন্ধ করা যায় এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা যায়।” তিনি আবারও জানান যে যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোর সরকারকে বৈধ বলে স্বীকার করে না। উল্লেখ্য, মাদুরো গত বছরের বিতর্কিত নির্বাচনে জয়ী হন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভেনেজুয়েলার মধ্যে ২০১৯ সাল থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই।
মাদকবিরোধী লড়াইয়ে ট্রাম্প কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন?
২০২৫ সালের ২১ জানুয়ারি, ট্রাম্প তার শপথগ্রহণের দিনই একটি নির্বাহী আদেশে আন্তর্জাতিক মাদকচক্রগুলোকে “বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে ঘোষণা করেন। আদেশে বলা হয়, “মেক্সিকোর নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে এই চক্রগুলো প্রায় একটি ছায়া সরকারের মতো কাজ করছে।”
এই আদেশের বিরোধিতা করে মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লাউদিয়া শেইনবাউম বলেন, “আমরা মাদক পাচারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করবো, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই মার্কিন হস্তক্ষেপ আমাদের ভূখণ্ডে মেনে নেওয়া হবে না। আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
ট্রাম্প কানাডা ও মেক্সিকোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল পাচার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে — যদিও এসব অভিযোগের পক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দেননি। ট্রাম্প যখন মেক্সিকোর ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে শেইনবাউম সীমান্তে ১০,০০০ ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন করেন।
২০ ফেব্রুয়ারি, মার্কিন বিদেশ দপ্তর ৮টি আন্তর্জাতিক মাদকচক্রকে “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে চিহ্নিত করে, যার মধ্যে ছিল:
মেক্সিকো ভিত্তিক: Cartel del Golfo, Sinaloa Cartel, Cartel de Jalisco Nueva Generacion, Carteles Unidos, La Nueva Familia Michoacana, Cartel del Noreste
ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক: MS-13 (Mara Salvatrucha)
ভেনেজুয়েলা ভিত্তিক: Tren de Aragua
পরে ফেব্রুয়ারিতে, মেক্সিকো ২৯ জন মাদকচক্র নেতাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেয়।
মাদুরোর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে মাদুরো ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়োসদাদো কাআবেলো মাদকচক্র Cartel de los Soles-এর সঙ্গে যুক্ত, যেটিকে ওয়াশিংটন “সন্ত্রাসী সংগঠন” হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে মাদুরো এসব অভিযোগ আগে থেকেই অস্বীকার করে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র এখন পর্যন্ত কোনো প্রমাণ প্রকাশ করেনি, যা মাদুরোকে সরাসরি মাদকচক্রের সঙ্গে যুক্ত করে।
এই মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র মাদুরোর ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ঘোষিত পুরস্কার ৫০ মিলিয়ন ডলার করেছে। ৭ আগস্ট, মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি এক ভিডিওতে মাদুরোর বিরুদ্ধে Tren de Aragua ও মেক্সিকোর Sinaloa Cartel-এর সঙ্গে কাজ করার অভিযোগ তোলেন। চলতি বছর, কাআবেলোর পুরস্কার মূল্যও ১০ মিলিয়ন থেকে ২৫ মিলিয়ন ডলার করা হয়েছে।
২০২০ সালে ট্রাম্পের প্রথম দফার সময়, মাদুরো এবং তার ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে নিউ ইয়র্কে “নার্কো-সন্ত্রাসবাদ” ও কোকেন আমদানি ষড়যন্ত্রের অভিযোগে ফেডারেল মামলা দায়ের করা হয়।
ভেনেজুয়েলার সরকার কী বলছে?
সোমবার, কাআবেলো ঘোষণা করেন যে, সরকার ১৫,০০০ সেনা মোতায়েন করছে কলম্বিয়া সীমান্তবর্তী জুলিয়া ও টাচিরা রাজ্যে। তিনি জানান, এ বছর ইতিমধ্যে ৫৩ টন মাদক জব্দ করা হয়েছে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম Noticias Venevision জানায়, সীমান্ত অঞ্চলে বিমানের টহল, ড্রোন ও নদীপথ নিরাপত্তা জোরদার করা হবে। কাআবেলো কলম্বিয়ার প্রতিও অনুরোধ জানান, যেন তারা তাদের অংশে একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করে।