প্রসেনজিৎ চৌধুরী: জেন জি ক্ষোভের রেশ ধরে গণবিদ্রোহে নেপাল (Nepal) সরকারের পতন। রক্তাক্ত নেপালের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান তথা দেশটির প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হলেন সুশীলা কার্কি। তার জীবনে জড়িয়ে আছেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি নেপালের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য রোমহর্ষক বিমান অপহরণে জড়িত।বিশ্বের গণতন্ত্র ইতিহাসে এমন ঘটনা আর নেই বললেই চলে।
সুশীলা কার্কির স্বামী দুর্গা প্রসাদ সুবেদী। তিনিই বিখ্যাত বিমান অপহরণের এক নায়ক ও ঘটনাটির লেখক। তার লেখা “বিমান বিদ্রোহ” বই। রাজতন্ত্র বিরোধী সংঘর্ষে নেপালি কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিমান অপহরণ করে সরকারি টাকা লুট করা হয়েছিল। রোমহর্ষক সেই ঘটনা।
উল্লেখ্য, সুশীলা কার্কি ভারতে পড়তে এসেছিলেন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন তার সঙ্গে পরিচয় হয় দুর্গা প্রসাদ সুবেদীর। পরিচয় থেকে প্রেম ও পরে পরিণয়ে আবদ্ধ হন দুজনেই।
নেপালের অত্যাচারী রাজতন্ত্র ও রাণাশাহী ( মন্ত্রীগোষ্ঠীর শাসন) ধংস করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য নেপালি কংগ্রেস দল ১৯৫০ – ১৯৫১ দশকে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমেছিল। সেই সংঘর্ষের মূল পরিকল্পনা কেন্দ্র কলকাতা। ভারতের সোশ্যালিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সঙ্গে যোগাযোগ করেন নেপালি কংগ্রেস নেতৃত্ব। সমাজবাদী নেতা ভোলা চট্টোপাধ্যায় গোপনে তৎকালীন বার্মার সমাজবাদী ও কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগ্নেয়ায়াস্ত্র সংগ্রহ করেন। সংঘর্ষ শুরু হয়। নেপালের এই রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে রাণাশাহীর পরাজয় হয় বিরাটনগরে। নেপালে শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্ব।
পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে নেপালি কংগ্রেস, নেপালের কমিউনিস্ট পার্টি এবং আরো পরে নেপালি মাওবাদীদের ত্রিমুখী আঘাতে রাজতন্ত্রের সম্পূর্ণ পতন হয় ২০০৮ সালে।
নেপালের এই রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের মধ্যে ১৯৭০ দশক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই দশকেই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য গান্ধীবাদী নেপালি কংগ্রেস দল বিমান অপহরণ করেছিল। ভারতের মাটিতে সে এক রোমহর্ষক পর্ব।
সীমান্ত শহর বিরাটনগর। Nepal- ১০জুন, ১৯৭৩ সাল।
সকাল সাড়ে আটটা বাজে। ঠিক সময়েই বিরাটনগর বিমানবন্দর থেকে কাঠমাণ্ডুর দিকে উড়ল রয়াল নেপাল এয়ারলাইনসের ছোট্ট প্লেন। যাত্রী সবমিলে উনিশ জন। হঠাৎ যাত্রীদের চমকে দিয়ে দুই যুবকের হুঙ্কার- এই বিমান অপহরণ করা হয়েছে।
লাফ দিয়ে অপহরণকারীরা ককপিটের কাছে চলে গেল। নেপালি ও হিন্দিতে তারা বিমান ধংস করার হুমকি দিতে শুরু করে। একজন পরিষ্কার নেপালি ভাষায় জানায়, বিমানটি হাইজ্যাক করা হয়েছে। পাইলটকে হুকুম দেওয়া হয় বিমান নামাতে হবে।
মাঝ আকাশে বিপদ! যাত্রীরা আতঙ্কিত। প্রাণভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাইলট কয়েকবার আকাশে চক্কর কেটে বুঝলেন ল্যান্ড করার জায়গা নেই। এদিকে ঘাড়ের কাছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হাজির। তাদের নির্দেশ- বিমান নামাতেই হবে। কোনওরকমে একটা ঘাস জমির উপরে সেই বিমান নামাতে পারলেন পাইলট।
গোঁত্তা খেয়ে বিমানটি যেখানে নামল সেটা ভারতের ভূখন্ড! জায়গাটার নাম ফরবেসগঞ্জ। বিহারের একটি মাঝারি জনপদ। তৎকালীন পূর্ণিয়া জেলার ফরবেসগঞ্জ এখন উত্তর বিহারের আরারিয়া জেলার অংশ।
যাত্রীরা ভয়ে কাঁপছেন। তবে অপহরণকারীরা জানায় কারোর ক্ষতি হবে না। নেপাল রাজার বিরুদ্ধে এই গেরিলা হামলা চালানো হচ্ছে। বলে কী এরা! রাজার বিরুদ্ধে লড়ছে নাকি, হতচকিত যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন মনে মনে সাবাসি জানালেন হয়ত। মুখে কিছু বলার সাহস হলো না। যদি গুলি চালিয়ে দেয়।
সেই বিমানে ছিল নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের তিরিশ লক্ষ টাকা। সবই ভারতীয় নোট। অপহরণকারীরা জানায় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করতে ওই টাকা লুট করা হচ্ছে।
ফরবেসগঞ্জের সেই ঘাসে ঢাকা মাঠের পাশে জঙ্গল। সেখানে তিনটি জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন নেপালি কংগ্রেসের মোস্ট ওয়ান্টেড নেতা গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালা আর তাদের ভারতীয় বন্ধুরা। বিমানটি নামতেই টাকার ট্রাঙ্ক জিপে তুলে নিলেন সবাই। জিপটা এবড়ো খেবড়ো পথ ধরে জঙ্গলের পাশ দিয়ে দ্রুত চলে গেল।
বিমান অপহরণ, টাকা লুট সব পরিকল্পনামাফিক হতেই বিমানটি ফের কাঠমাণ্ডুর দিকে উড়ে গেল। গোপন আস্তানায় আশ্রয় নিলেন নেপালি কংগ্রেসের নেতারা। কেউ গেলেন দার্জিলিং। কেউ চলে গেলেন কলকাতা, পাটনা, বারাণসীসহ বিভিন্ন শহরে।
নেপাল রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের জন্য বরাদ্দ টাকা ভারত থেকেই যেত তখন। সেবারও নিয়ম করে বিহারের আরারিয়া থেকে সড়ক পথে নেপালের বিরাটনগরে টাকার ট্রাঙ্ক পাঠানো হয়েছিল। এ ব্যাপারটা অজানা ছিল না নেপালি কংগ্রেস নেতাদের। বিদ্রোহ পরিচালনার জন্য বিরাটনগর থেকেই সরকারি লুট করার ছক করা হয়। পরিকল্পনা সফল হয়।
যখন বিমান নামিয়ে টাকা লুট চলেছে ততক্ষণে বিরাটনগর থেকে কাঠমাণ্ডু বিমানবন্দরকে এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সতর্ক বার্তায় তীব্র শোরগোল পড়ে গেছে। শুরু হল নেপাল-ভারত কূটনৈতিক সংঘাত।ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে বিমান অপহরণ ও টাকা লুঠে জড়িত নেপালি কংগ্রেস।
নেপালের দাবি, যারা এমন করেছে তাদের জলদি গ্রেফতার করুক ভারত সরকার। ভারতের রাজনৈতিক অন্দরমহলে উদ্বেগ বাড়ছিল। কারণ, কংগ্রেস তখন দেশের ক্ষমতায়। বিহারে তাদেরই সরকার। আর কে না জানে, ভারত-নেপাল দুই দেশের কংগ্রেসের মধ্যে ‘মধুর’ সম্পর্কের কথা। ষড়যন্ত্রের পর্দা যত উঠছিল ততই বিব্রত হচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
ফরবেসগঞ্জের সেই মাঠ থেকে জিপ তখন নির্দিষ্ট সেফ হাউসের দিকে চলে গিয়েছে। অপহরণকারীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। একবার খবর আসছে তারা দার্জিলিংয়ে লুকিয়ে আছে। আবার জানা যাচ্ছে বারাণসীর গলিতে তাদের দেখা যাচ্ছে। অথচ ধরা যাচ্ছে না। নেপাল থেকে কূটনৈতিক চাপে নাজেহাল ভারত সরকার। এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেসের নেতৃত্ব গোপনে তাদের নেপালি কংগ্রেসের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। দু’পক্ষের বিস্তর আলোচনায় ঠিক হয় পরিস্থিতি সামলে নেওয়া হবে। সবুজ সংকেত আসার পর বিমান অপহরণে জড়িত গিরিজা প্রসাদ কৈরালা, সুশীল কৈরালাসহ কয়েকজন ধরা দেন। তাদের ভারতেই গ্রেফতার করা হয়। তবে লুট করা সেই টাকার হদিস মেলেনি।
১৯৭৩ সালের পর পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছিল। ভারতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাধছিল। প্রতিবেশি নেপালে সে দেশের কংগ্রেসের নেতৃত্বে রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন জমাট হচ্ছিল। ১৯৭৫ সালে ভারতে জরুরি অবস্থা জারি ও তুমুল সরকার বিরোধী গণ আন্দোলনের ঝঞ্ঝাময় সময়। সেই ধাক্কায় ১৯৭৭ সালে ইন্দিরার পরাজয় হয় ও জনতা পার্টির সরকার ক্ষমতায় আসে।মুক্তি পান বিমান অপহরণকারী নেপালি কংগ্রেস নেতৃত্ব। ভারত থেকে নেপালে ফিরে তাঁরা রাজতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনে নেমে পড়েন।
রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে তীব্র সংঘর্ষের কেন্দ্র নেপাল। দশকের পর দশক এই সংঘর্ষ চলেছে গণ আন্দোলন ও সশস্ত্র পথে। ২০০৮ সালে নেপালে রাজতন্ত্র ধসে পড়ে। রাজপরিবার পুরোপুরি ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আর নব্বই দশক থেকে যে রাজা নিয়ন্ত্রিত গণতান্ত্রিক কাঠামো চলছিল তাতে অংশ নিয়ে বারবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী হয়ে নজির গড়েন গিরিজা প্রসাদ কৈরালা। পরে তাঁর ভাইপো সুশীল কৈরালা হন প্রধানমন্ত্রী। দু’জনেই বিমান অপহরণ করে বিহার থেকে টাকা লুট করা স্বীকার করেছেন। নেপাল তথা উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই দুই কংগ্রেস নেতা আদতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে জীবনভর সংগ্রাম করেছেন। সফল হয়েছেন। বিহারের মাটিতে এই বিমান অপহরণ ঘটনা তাঁদের সংগ্রামী জীবনের সফল অধ্যায়ের একটি। গণতন্ত্রাতিক অধিকারের জন্য বিমান অপহরণ, এমনই ব্যাখ্যা দিয়েছে নেপালি কংগ্রেস।;গণতন্ত্রের জন্য এই বিমান অপহরণকারীদের অন্যতম দুর্গা প্রসাদ সুবেদী। তিনি সেই ঘটনার পুর্ণাঙ্গ বিবরণ লিখেছেন।
সেদিন বিরাটনগর থেকে কাঠমাণ্ডুর বিমান যাত্রী ছিলেন অভিনেত্রী মালা সিনহা। তবে তিনি পুরো ঘটনা কোনোদিন প্রকাশ করেননি। তার সামনেই সব ঘটেছিল, সেটি তদন্তে উঠে আসে। অভিনেত্রীর মা জন্মসূত্রে নেপালি। কেন তিনি নীরব? আর কিছু বলার বাকি থাকে!