সাম্প্রতিক একটি রিপোর্টে আতঙ্কজনক তথ্য উদঘাটিত হয়েছে যে, বিশ্বের কিছু গরিব দেশ খাদ্য নষ্ট (Food Waste) করার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। ইউএনইপি (সংযুক্ত রাষ্ট্র পরিবেশ কর্মসূচি) ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স রিপোর্ট ২০২৪-এর তথ্য অনুযায়ী, মালদ্বীপ, ইজিপ্ট, ইরাক এবং পাকিস্তানের মতো দেশগুলো প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর বাড়ির পরিবারে খাদ্য নষ্ট করছে যা বিশ্ব গড়ের তুলনায় অনেক বেশি। এই তথ্য বিশ্বজুড়ে চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে যেহেতু এই দেশগুলো অর্থনৈতিক দিক থেকে উন্নত নয় এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য সংগ্রামরত। আজকের এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়ে গভীরভাবে আলোচনা করব।
মালদ্বীপ: সর্বোচ্চ খাদ্য নষ্টের রেকর্ড
রিপোর্ট অনুযায়ী, মালদ্বীপ প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর ২০৭ কিলোগ্রাম খাদ্য নষ্ট করে, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। এই ছোট দ্বীপপুঞ্জ দেশটি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, এবং এই খাতে খাদ্যের ব্যবহার ও নষ্টকরণের হার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে বিলাসবহুল খাদ্য পরিবেশনের কারণে অতিরিক্ত খাদ্য তৈরি হয়, যা পরে নষ্ট হয়ে যায়। ২০২১ সালের একটি নেচার ফুড গবেষণা অনুসারে, ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোতে পর্যটন খাদ্য নষ্টকরণের হারকে ৩০% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, মালদ্বীপের জনবসতি কম এবং আমদানি নির্ভরশীল খাদ্য ব্যবস্থা থাকায় সঞ্চয় ও বিতরণে সমস্যা দেখা দেয়, যা নষ্টকরণের কারণ হয়ে ওঠে।
ইজিপ্ট ও ইরাক: উচ্চ নষ্টকরণের পেছনে কারণ
ইজিপ্টে প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর ১৬৩ কিলোগ্রাম এবং ইরাকে ১৪৩ কিলোগ্রাম খাদ্য নষ্ট হয়। এই দেশগুলোতে খাদ্য নষ্টকরণের মূল কারণ হলো অপর্যাপ্ত সঞ্চয় ব্যবস্থা, কৃষি উৎপাদনের অতিরিক্ততা এবং বাজারে পৌঁছানোর পূর্বে খাদ্যের মান নষ্ট হওয়া। ইজিপ্টের মতো দেশে নদী ও উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও, আধুনিক প্রযুক্তি ও শীতল সঞ্চয়ের অভাবে খাদ্য নষ্ট হয়। ইরাকের ক্ষেত্রে, যুদ্ধ ও অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি সরবরাহ শৃঙ্খলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যার ফলে খাদ্য নষ্টকরণ বেড়েছে।
ভারতের অবস্থা: গড়ের নিচে, তবুও উদ্বেগজনক
ভারতের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর ৫৫ কিলোগ্রাম খাদ্য নষ্ট হয়, যা বিশ্ব গড় (৭৯ কিলোগ্রাম) থেকে কম। এটি নির্দেশ করে যে ভারতের সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি খাদ্য নষ্টকরণ কমাতে সাহায্য করে। ছোট পরিমাণে খাদ্য রান্না এবং বাকি খাদ্য পুনর্ব্যবহারের প্রথা এখানে প্রচলিত। তবে, জনসংখ্যার বিশালত্ব বিবেচনা করলে মোট খাদ্য নষ্টকরণের পরিমাণ তথা ৫৫০ লক্ষ টনের কাছাকাছি, যা উদ্বেগজনক।
রাশিয়া: নিম্ন নষ্টকরণের মডেল
বিপরীতভাবে, রাশিয়া প্রতি ব্যক্তি প্রতি বছর মাত্র ৩৩ কিলোগ্রাম খাদ্য নষ্ট করে, যা বিশ্বে সর্বনিম্ন। ২০২৩ সালের একটি জার্নাল অফ ক্লিনার প্রোডাকশন গবেষণা অনুসারে, রাশিয়ার কঠোর খাদ্য সংরক্ষণ আইন এবং সাংস্কৃতিকভাবে খাদ্য নষ্ট করার প্রতি বিরোধিতা এর কারণ। অতীতের দুর্ভিক্ষের স্মৃতি রাশিয়ানদের খাদ্যকে মূল্যবান হিসেবে দেখতে শিখিয়েছে। এই মডেলটি অন্যান্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে।
পরিবেশ ও অর্থনৈতিক প্রভাব
খাদ্য নষ্টকরণের ফলে পরিবেশে গুরুতর ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী খাদ্য নষ্টকরণ গ্রিনহাউস গ্যাসের ৮-১০% দায়ী, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করে। অর্থনৈতিক দিক থেকে, ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য নষ্টকরণের ক্ষতি ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। গরিব দেশগুলোতে এই নষ্টকরণ অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করছে, কারণ এই দেশগুলোর জনগণের কাছে খাদ্য একটি বিলাসিতা নয়, বরং জীবনের মৌলিক প্রয়োজন।
সমাধানের পথ
খাদ্য নষ্টকরণ কমাতে জনসচেতনতা বাড়ানো, আধুনিক সঞ্চয় প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং পর্যটন খাতে নষ্টকরণ নিয়ন্ত্রণের কঠোর নীতি প্রয়োজন। ভারতের মতো দেশে স্থানীয় স্তরে খাদ্য বিনিময় ব্যবস্থা চালু করা এবং শিক্ষা প্রদান করা উপযুক্ত হতে পারে। রাশিয়ার মতো সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ গ্রহণও একটি সম্ভাব্য সমাধান।
খাদ্য নষ্টকরণ একটি গ্লোবাল চ্যালেঞ্জ, যা গরিব ও ধনী দেশের মধ্যে পার্থক্য করছে না। মালদ্বীপ, ইজিপ্ট ও ইরাকের মতো দেশগুলোর জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা, যা তাদের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সমযোগসূত্রে, আমাদের সবাইকে এই সমস্যার সমাধানে অংশ নিতে হবে, যাতে খাদ্য নষ্টকরণ কমে এবং পৃথিবী একটি সুস্থ ভবিষ্যৎ পায়।