Farida Parvin: না ফেরার দেশে লালন সাম্রাজ্ঞী ফরিদা পারভিন

চলে গেলেন ওপার বাংলার বিখ্যাত লোকগীতি গায়িকা ফরিদা পারভিন (Farida Parvin)। লোকগান বিশেষ করে লালন ফকিরের গান তিনি যেভাবে মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাতে…

Farida Parvin passes away

চলে গেলেন ওপার বাংলার বিখ্যাত লোকগীতি গায়িকা ফরিদা পারভিন (Farida Parvin)। লোকগান বিশেষ করে লালন ফকিরের গান তিনি যেভাবে মানুষের হৃদয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তাতে তিনি সবসময় মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। অনেকদিন ধরেই কিডনির সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।

নাটোরের সিংড়ায় ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ফরিদা পারভীনের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিভিন্ন শহরে। যেখানেই গেছেন সেখানেই গানের প্রতি তাঁর টান প্রথম থেকেই স্পষ্ট হয়েছে। বাবা দেলোয়ার হোসেনের চাকরির কারণে যার পরিবার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে এবং এই যাত্রাই তাঁর শিক্ষাজীবনকে বৈচিত্র্যময় করে তোলে। মাগুরায় শুরু হয় তাঁর স্কুলজীবন এবং যেখানে গানের প্রথম স্পর্শ ঘটে।

   

ফরিদা পারভীনের স্কুলজীবন মাগুরা জেলায় শুরু হয়। পরে তিনি কুষ্টিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং পড়াশোনা শুরু করেন। কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয়ে তিনি পড়াশুনা করেন, যেখানে তাঁর শিক্ষকরা তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও সংগীতপ্রতিভার প্রশংসা করতেন।

পরিবারের স্থানান্তরের কারণে তিনি মেহেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়েও পড়েন। এই স্কুলগুলোতে তিনি স্কুল ম্যাগাজিনে গান লিখে এবং গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন। ১৯৭২ সালে কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন বালিকা বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন, যা তাঁর শিক্ষাজীবনের একটি মাইলফলক। এই সময় থেকেই গান তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

পরিবারের সদস্যরা বলেন, স্কুলের বছরগুলোতে তিনি বন্ধুদের সঙ্গে গানের আসর বসাতেন এবং সেখানে প্রথম পেয়েছিলেন লালনের ছোঁয়া।উচ্চশিক্ষায় ফরিদা পারভীন ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এইচএসসি-র পর তিনি কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৭৬-১৯৭৯ সালে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর আগ্রহ স্পষ্ট ছিল, কারণ লালনের গানগুলোতে সাহিত্যের গভীরতা লুকিয়ে আছে। কলেজের দিনগুলোতে তিনি বিতর্কে অংশ নিতেন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়ে সকলকে মোহিত করতেন। এই সময় তাঁর স্বামী, প্রখ্যাত গীতিকার আবু জাফরের সঙ্গে পরিচয় হয়, যা তাঁর জীবনকে নতুন মোড় দেয়।

শিক্ষাজীবনের এই অংশে তিনি সংগীতের পাশাপাশি সাহিত্যের গভীর জ্ঞান অর্জন করেন, যা পরবর্তীকালে তাঁর গানের ব্যাখ্যায় সহায়তা করে।ফরিদা পারভীনের গানের শিক্ষাজীবনও মাগুরা থেকে শুরু হয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে, মাত্র চার-পাঁচ বছর বয়সে, তিনি ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে গানের হাতেখড়ি দেন।

এই প্রথম স্পর্শ তাঁর জীবনকে গানের পথে নিয়ে যায়। পরে কুষ্টিয়ায় স্থানান্তরের পর তিনি তখনকার বিখ্যাত ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণির কাছে ক্লাসিক্যাল শেখেন।

Advertisements

প্রায় ছয়-সাত বছর তানপুরার সঙ্গে ক্লাসিক্যাল চর্চা করেন, যা তাঁর কণ্ঠকে শক্তিশালী করে। এরপর তিনি নজরুল সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকেন এবং কুষ্টিয়ার ওস্তাদ আবদুল কাদেরকে প্রথম গুরু মানেন। মেহেরপুরে মীর মোজাফফর আলীর কাছে নজরুলের গান হারমোনিয়াম এবং কণ্ঠে তোলার স্বরলিপি শেখেন।

১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন, যা তাঁর পেশাদার জীবনের সূচনা করে।বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর লালন সাঁইয়ের গানের সঙ্গে ফরিদা পারভীনের যোগাযোগ গভীর হয়। কুষ্টিয়ায় থাকাকালীন তাঁর পারিবারিক বন্ধু গুরু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মাধ্যমে লালনের গানে আগ্রহ জাগে।

১৯৭৩ সালে ‘সত্য বল সুপথে চল’ গান শিক্ষার মাধ্যমে তিনি লালন সঙ্গীতের তালিম নেন। মোকছেদ আলী সাঁইয়ের মৃত্যুর পর খোদা বক্স সাঁই, ব্রজেন দাস, বেহাল সাঁই, ইয়াছিন সাঁই এবং করিম সাঁইয়ের কাছে লালনের গান শেখেন। এই গুরুদের কাছ থেকে তিনি লালনের দার্শনিক গভীরতা এবং লোকসনাতনী সুরের রহস্য উন্মোচন করেন।

লালনের গানগুলোকে তিনি আধুনিক প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেন এবং ‘লালনকন্যা’ নামে পরিচিত হন। তাঁর কণ্ঠে ‘মিলন হবে কত দিনে’ বা ‘অচিন পাখি’ গানগুলো বাঙালির হৃদয় জয় করে।ফরিদা পারভীন শুধু গাইতেন না, শেখাতেনও। তিনি ‘অচিন পাখি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করে শিশুদের লালন সংগীত শিক্ষা দেন।

একুশে পদক এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তাঁর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। কিডনি জটিলতায় দীর্ঘদিন ভুগছিলেন তিনি, এবং সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতেন। কাল রাতে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাকালীন তিনি চলে যান।

Asia Cup 2025: আবুধাবিতে বাংলাদেশকে ৬ উইকেটে হারিয়ে অভিযান শুরু শ্রীলঙ্কার

স্বামী গাজী আবদুল হাকিম এবং ছেলে ইমাম জাফর নোমানীর মুখে মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হয়। ফরিদা পারভীনের চলে যাওয়া বাংলা সংগীত জগতে অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু তাঁর শিক্ষা ও গানের উত্তরাধিকার চিরকাল বেঁচে থাকবে সংগীত প্রেমী মানুষের মধ্যে।