নয়াদিল্লি: ভারত-জাপান (Japan) সম্পর্কের ইতিহাসে নতুন মাইলফলক গড়ল শুক্রবার টোকিওতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার দ্বিপাক্ষিক শীর্ষ বৈঠক। বৈঠকের পর জাপান ঘোষণা করল আগামী ১০ বছরে ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতে ১০ ট্রিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বিনিয়োগের লক্ষ্য। দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা জোট গড়ে তুলতে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়েছে Economic Security Initiative, যা কৌশলগত ক্ষেত্রগুলিতে সরবরাহ শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি বিনিয়োগকে ত্বরান্বিত করবে।
বৈঠকের মূল ফোকাস ছিল অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর, টেলিকম, ওষুধশিল্প এবং উদীয়মান প্রযুক্তিতে যৌথ অংশীদারিত্ব। এর পাশাপাশি দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে Security Cooperation-এর ওপর একটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেন, যা প্রতিরক্ষা শিল্প ও সামরিক উদ্ভাবনে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতাকে আরও মজবুত করবে।
মোদী বৈঠকে বলেন, “ভারত ও জাপান শুধু দুই বড় অর্থনীতি নয়, দুই শক্তিশালী গণতন্ত্রও। আমাদের অংশীদারিত্ব শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সহযোগিতা পারস্পরিক আস্থা, জাতীয় অগ্রাধিকারের প্রতিফলন এবং যৌথ মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে।”
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইশিবা বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এই সময়ে আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে আরও শক্তিশালী করার দায়িত্ব আমাদের। জাপান ও ভারত মিলে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে।”
জাপান ইতিমধ্যেই ২০২২-২৬ সময়সীমায় নির্ধারিত ৫ ট্রিলিয়ন ইয়েন বিনিয়োগের লক্ষ্য নির্ধারিত সময়ের দুই বছর আগেই পূর্ণ করেছে। এবার নতুন বিনিয়োগ পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে মুম্বই-আহমেদাবাদ উচ্চগতির বুলেট ট্রেন প্রকল্পে শিনকানসেন প্রযুক্তি আনা এবং নৌপরিবহন, বিমান চলাচল ও জাহাজ নির্মাণে অংশীদারিত্ব। চাঁদের অভিযানে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO) ও জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সি (JAXA)-র মধ্যে চন্দ্রযান-৫ মিশনে সহযোগিতার চুক্তিও হয়েছে।
মানবসম্পদ বিনিময়ের ক্ষেত্রেও দুই দেশ বড় পদক্ষেপ নিয়েছে। আগামী পাঁচ বছরে ৫ লাখ মানুষকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিময় কর্মসূচির আওতায় আনা হবে, যার মধ্যে ৫০ হাজার দক্ষ ভারতীয় জাপানের অর্থনীতিতে সরাসরি অবদান রাখবে। ইশিবা স্বীকার করেছেন যে জাপানে ভারতীয় STEM প্রতিভার প্রয়োজন অনেক বেশি এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে আরও ভারতীয় দক্ষ কর্মী প্রয়োজন।
অর্থনীতির পাশাপাশি প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও আলোচনার বড় অংশ ছিল। দক্ষিণ চীন সাগর ও পূর্ব চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী মনোভাবের প্রেক্ষিতে দুই প্রধানমন্ত্রী উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিয়মভিত্তিক ইন্দো-প্যাসিফিক নিশ্চিত করতে যৌথভাবে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। যৌথ বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো দেশ যেন জোরপূর্বক বা হুমকি দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি বদলাতে না পারে।
Global Trade Research Initiative (GTRI)-র বিশেষজ্ঞ অজয় শ্রীবাস্তব মনে করেন, ভারত-জাপান সহযোগিতার মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স, সবুজ জ্বালানি ও উন্নত উৎপাদন শিল্পে যৌথ উদ্যোগ নিলে তা বিশ্ব সরবরাহ শৃঙ্খলে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। তিনি বলেন, “১৯৮৩ সালে সুজুকি-মারুতি মডেল ভারতের গাড়ি শিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। আজকের অংশীদারিত্বও তেমন ঐতিহাসিক হতে পারে।”
এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা ভারতের ‘Make in India’ ও ‘Make for the World’ উদ্যোগকে গতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে এই নতুন অধ্যায় শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখবে।