ইসরায়েলি (Israel) সামরিক বাহিনী বুধবার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে অবস্থিত সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে, যা দেশটির সামরিক কাঠামোর উপর একটি বড় ধরনের আঘাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই হামলার মধ্যে তিনটি আঘাত প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের কাছাকাছি এলাকায় হয়েছে, যা সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
এই হামলাগুলি সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের সুয়াইদা প্রদেশে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং দ্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে চলমান সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে ঘটেছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর আগ্রাসন ঠেকাতে এই হামলা চালিয়েছে। এই ঘটনা সিরিয়ার ইতিমধ্যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা দামেস্কে সিরিয়ার সামরিক সদর দপ্তরের প্রবেশপথে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। এই হামলার লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার সামরিক অবকাঠামো, যা ইসরায়েলের দাবি অনুযায়ী, দ্রুজ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর কার্যকলাপে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইসরায়েল কাটজ বলেন, “যদি সিরিয়ার সরকারি বাহিনী সুয়াইদা থেকে প্রত্যাহার না করে, তবে আমরা আরও কঠোর হামলা চালাব।” তিনি আরও জানান, এই হামলা সুয়াইদায় দ্রুজ সম্প্রদায়ের উপর সিরিয়ার সামরিক আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে চালানো হয়েছে। সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই হামলায় কমপক্ষে নয়জন আহত হয়েছেন, তবে নিহতের কোনও তথ্য এখনও নিশ্চিত হয়নি।
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম সানা জানিয়েছে, ইসরায়েলি ড্রোন এবং যুদ্ধবিমান দামেস্কে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং জেনারেল স্টাফ সদর দপ্তরে আঘাত হানে। এছাড়া, প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেসের কাছাকাছি এলাকায় তিনটি হামলা চালানো হয়েছে, যার ফলে এলাকায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে।
রয়টার্সের একজন সাংবাদিক ঘটনাস্থলে ধোঁয়া ও ধ্বংসাবশেষের দৃশ্য দেখেছেন। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই হামলাকে “ইসরায়েলি আগ্রাসন” হিসেবে বর্ণনা করে এটিকে দেশের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন বলে সমালোচনা করেছে। তবে, সিরিয়ার নেতৃত্বের পক্ষ থেকে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
এই হামলার পটভূমিতে সুয়াইদা প্রদেশে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী এবং দ্রুজ মিলিশিয়ার মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার নিয়েছে। গত রবিবার থেকে শুরু হওয়া এই সংঘর্ষে বেদুইন উপজাতি এবং দ্রুজ মিলিশিয়ার মধ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে, যাতে ২৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে সাধারণ নাগরিক, সৈন্য এবং মিলিশিয়া যোদ্ধারা রয়েছেন।
ইউকে-ভিত্তিক সিরিয়ান অবজার্ভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস জানিয়েছে, সিরিয়ার সরকার ঘোষিত একটি যুদ্ধবিরতি মঙ্গলবার ভেঙে পড়ে, যার ফলে সুয়াইদায় সহিংসতা আরও বেড়ে যায়। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে এবং ইরান-সমর্থিত বাহিনীর প্রভাব কমাতে এই হামলা চালিয়েছে।
তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলার তীব্র নিন্দা করেছে। তারা বলেছে, “ইসরায়েলের এই হামলা সিরিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার লক্ষ্যে চালানো হয়েছে।” তুরস্কের মতে, গত ডিসেম্বরে বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার শান্তি ও বিশ্বের সঙ্গে একীভূত হওয়ার একটি ঐতিহাসিক সুযোগ ছিল, কিন্তু ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ তা বাধাগ্রস্ত করছে। হামাসও এই হামলার নিন্দা করে বলেছে, “ইসরায়েলের এই জঘন্য আগ্রাসন” সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দ্রুজ সম্প্রদায়কে সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম না করার জন্য অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা দ্রুজ সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার জন্য কাজ করছি, কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে।” ইতিমধ্যে, শতাধিক ইসরায়েলি দ্রুজ সুয়াইদায় তাদের সম্প্রদায়ের সমর্থনে সীমান্ত অতিক্রম করেছেন, যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে।
এই হামলা সিরিয়ার নতুন নেতৃত্বের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা সরকার গঠন করলেও, দেশজুড়ে তাঁদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তারা সুয়াইদায় “স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে” সামরিক অভিযান চালিয়ে যাবে। তবে, ইসরায়েলের এই হামলা এই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। একজন ব্যবহারকারী লিখেছেন, “ইসরায়েলের এই হামলা সিরিয়ার সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। এটি মধ্যপ্রাচ্যে আরও অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।” আরেকজন লিখেছেন, “ইসরায়েল দ্রুজ সম্প্রদায়কে রক্ষা করার নামে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।”
ভারতের ‘দেশীয় S-400- ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম
এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ইরান-সমর্থিত বাহিনীর প্রভাব কমানোর পাশাপাশি সিরিয়ার নতুন সরকারকে চাপে রাখার কৌশল। তবে, এই হামলার ফলে সিরিয়ার পাল্টা প্রতিক্রিয়া বা আঞ্চলিক সংঘাতের সম্ভাবনা বেড়েছে। আগামী দিনে এই ঘটনা কীভাবে বিবর্তিত হয়, তা নিয়ে সবার নজর রয়েছে।