ইসলামাবাদের রাস্তায় রাতভর উত্তেজনা। পাকিস্তানের (Pakistan) রাজধানীতে হাজার হাজার মানুষ হাতে পতাকা, মুখে পরিচিত স্লোগান- “আজাদি!”। ঘটনাটি নভেম্বরের ২৬ তারিখ ভোররাতে ছড়িয়ে পড়া একাধিক ভিডিওতে স্পষ্ট। পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআই (PTI)-র সমর্থকেরা ফের রাস্তায়, এক বছরের পুরনো ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে। কিন্তু এই প্রতিবাদের কেন্দ্রে যে স্লোগানটি সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছে, তা হল ভারতের একসময়ের ছাত্রনেতা ও বর্তমান সাংসদ কানহাইয়া কুমারের সেই ‘আজাদি’ ডাক, যেটি ২০১৬ সালের জেএনইউ আন্দোলন এবং পরে ২০১৯-২০-র অ্যান্টি-সিএএ বিক্ষোভে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিল।
এই স্লোগান এখন ইসলামাবাদের ফয়সল অ্যাভিনিউ, জিরো পয়েন্ট, ব্লু এরিয়ার রাস্তায়। অনেকে এটিকে ব্যঙ্গাত্মক ‘কর্মফল’ বলছেন, কারণ ভারতের প্রান্তিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে দাবি ছিল, পাকিস্তানের আইএসআই নাকি জেএনইউ বা অ্যান্টি-সিএএ আন্দোলনে গোপনে ‘আজাদি’ স্লোগানের প্রচারে ভূমিকা নিয়েছিল। এবার সেই একই স্লোগান পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র, বিশেষত সেনা ও গুপ্তচর সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে- যেন বুমেরাং হয়ে ফিরেছে।
ইমরান খান ‘মৃত’—রটনার জেরেই বিস্ফোরক পরিস্থিতি
প্রতিবাদকে উসকে দিয়েছে আরও একটি বড় খবর- ইমরান খান নাকি কারাগারে মারা গেছেন, এমন রটনা। যদিও সরকারি এবং কারা কর্তৃপক্ষ তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে, কিন্তু ক্ষোভে ফুঁসছে পিটিআই সমর্থকেরা। আদিয়ালা জেলের সামনে রাতভর বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি, টিয়ার গ্যাস ছোড়া—সব মিলিয়ে রাজধানী জুড়ে অশান্ত পরিবেশ।
সঙ্গে রয়েছে সেকশন ১৪৪-এর বিধিনিষেধ। রাস্তায় পাঁচ জনের বেশি জটলা নিষিদ্ধ। কিন্তু পিটিআই সমর্থকেরা সেই নির্দেশ মানেনি। পুলিশের লাঠিচার্জ, রাস্তা ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ, বহু কর্মীকে আটক—সবই চলেছে পাশাপাশি।
‘ব্ল্যাক ডে’–র বার্ষিকী এবং পিটিআইয়ের হতাশা
২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর পাকিস্তানে ঘোষণা করা হয়েছিল ‘ব্ল্যাক ডে’। সারা দেশজুড়ে পিটিআই সমর্থকদের বিরুদ্ধে তুমুল দমনপীড়ন, ইমরান খানের গ্রেফতার, সেনা আদালতে বিচার—সব মিলিয়ে তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা ওই দিন থেকেই। তার বর্ষপূর্তিতেই আরও বড় আকারে রাস্তায় নামে অসন্তুষ্ট জনতা।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বিক্ষোভের মাধ্যমে পিটিআই শুধু ইমরানের সুরক্ষা নিয়ে উদ্বেগ জানাচ্ছে না, বরং পাকিস্তানের সেনা-প্রভাবিত রাজনীতির বিরুদ্ধে একরকম বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। একই সময়ে ‘আজাদি’ স্লোগান তুলে তারা যেন বলছে—“স্বাধীনতা চাই, সামরিক হস্তক্ষেপের অবসান চাই।”
Karma!!!
“Hum le ke rahenge … Aazadi”:Pakistan ISI & Army used this slogan in India through its proxies.
Now Karma is hitting them back.
Islamabad last night 👇 pic.twitter.com/xwma2py58u— Megh Updates 🚨™ (@MeghUpdates) November 26, 2025
ভারতের সঙ্গে অদ্ভুত এক সমান্তরাল
২০১৬ সালে কানহাইয়া কুমার জেএনইউ ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আজাদি- দারে দারে আজাদি, খেদ মতভেদ থেকে আজাদি, গরিবির থেকে আজাদি!” সেই স্লোগান পরবর্তীতে ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক চিহ্নে পরিণত হয়। ২০১৯–২০ সালে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ আরও ‘আজাদি’ স্লোগানের ব্যাপক প্রচার ঘটায়।
ভারতের একটি বড় অংশ বরাবরই অভিযোগ করে এসেছে—আইএসআই ও পাকিস্তানি প্রচারযন্ত্র নাকি গোপনে ওই স্লোগানকে ভারত বিরোধী আন্দোলনে জ্বালানির মতো ব্যবহার করেছিল। যদিও এসব অভিযোগের কোনও সরকারি প্রমাণ নেই, তবু রাজনৈতিক বিতর্ক ছিল প্রবল।
এবার সেই একই স্লোগান পাকিস্তানেই সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের মুখে। ভারতীয় মহলে তাই ব্যঙ্গ—“যে আগুন অন্য দেশে ছড়াতে চেয়েছিল, সে আগুন এবার নিজেদের ঘরেই লেগেছে।”
পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ভবিষ্যৎ কোনদিকে?
ইসলামাবাদের বিক্ষোভ আপাতত সাময়িকভাবে দমন করা গেলেও বিস্ফোরণ থামেনি। ইমরানের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, পিটিআইয়ের মধ্যে বিভাজন, সেনার সঙ্গে দ্বন্দ্ব- সব মিলিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক মানচিত্র আরও জটিল হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘আজাদি’ স্লোগান পাকিস্তানে এভাবে জনপ্রিয় হওয়া শুধুই প্রতিবাদের ভাষা নয়, বরং একটি নতুন ধারার সূচনা। তরুণ সমাজ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশ এখন খোলাখুলি সামরিক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করছে।
কানহাইয়া কুমারের ‘আজাদি’ স্লোগান একসময় ভারতের রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এখন সেই স্লোগান পাকিস্তানের রাস্তায়। ইতিহাস মাঝে মাঝে এমনই রসিকতা করে—যে দেশকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল স্লোগান ছড়ানোর জন্য, সেই দেশই আজ সেই স্লোগানে নিজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখোমুখি।
ইসলামাবাদে রাতভর আন্দোলন বার্তা দিয়েছে- ‘আজাদি’ আর শুধু ভারতের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার নতুন প্রতিরোধের ভাষা।
