আমেরিকার উটাহ রাজ্যের স্প্যানিশ ফোর্কে অবস্থিত ইসকন শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দির (ISKCON Temple Attack), যা বিশ্বব্যাপী তার বার্ষিক হোলি উৎসবের জন্য বিখ্যাত, সম্প্রতি একটি সন্দেহজনক হিন্দুবিরোধী ঘৃণা-অপরাধের শিকার হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে রাতের বেলায় মন্দিরের ভবন এবং এর আশপাশের এলাকায় ২০ থেকে ৩০টি গুলি চালানো হয়েছে, যার ফলে মন্দিরের কাঠামোতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়েছে। এছাড়াও, ক্যালিফোর্নিয়ার চিনো হিলসে অবস্থিত বোচাসনবাসী অক্ষর পুরুষোত্তম স্বামীনারায়ণ সংস্থা (ব্যাপস) মন্দিরেও এই বছরের মার্চ মাসে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে, যা একটি তথাকথিত ‘খালিস্তানি গণভোট’-এর ঠিক আগে ঘটেছিল। এই ঘটনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুবিরোধী ঘৃণা-অপরাধের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।
ইসকন মন্দিরে হামলা: বিস্তারিত
ইসকন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যে, স্প্যানিশ ফোর্কের শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে গত জুন মাসে তিনবার গুলি চালানো হয়েছে। এই হামলাগুলো রাতের বেলায় সংঘটিত হয়েছে, যখন মন্দিরে ভক্ত এবং অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন। গুলির ফলে মন্দিরের হাতে খোদাই করা তোরণ এবং প্রধান পূজা কক্ষের দেয়াল সহ বিভিন্ন অংশে ক্ষতি হয়েছে, যার মূল্য হাজার হাজার ডলার। নিরাপত্তা ক্যামেরায় একটি পিকআপ ট্রাক মন্দিরের প্রধান ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে, যদিও এখনও কোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করা যায়নি। উটাহ কাউন্টি শেরিফের কার্যালয় এই ঘটনাগুলোকে ‘ভাঙচুর’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, ইসকন কর্তৃপক্ষ এটিকে স্পষ্টভাবে ‘ঘৃণা-অপরাধ’ বলে অভিহিত করেছে। শেরিফের কার্যালয় ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছু গুলির খোসা উদ্ধার করেছে এবং তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। তারা জনসাধারণের কাছে তথ্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছে এবং গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্ত করার জন্য তথ্য প্রদানকারীদের জন্য ১০০০ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
মন্দিরের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ভাই ওয়ার্ডেন এই হামলাকে ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “আমরা গত কয়েক দশক ধরে শান্তিপূর্ণভাবে এখানে কাজ করে আসছি। হঠাৎ করে এই ধরনের হামলা, যা ধর্মীয় বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে, আমাদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।” তিনি মন্দিরটিকে আবার শান্তির স্থান হিসেবে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করছেন।
ভারতের প্রতিক্রিয়া
সান ফ্রান্সিসকোতে ভারতীয় কনস্যুলেট এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কনস্যুলেটের একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা স্প্যানিশ ফোর্কের ইসকন শ্রী শ্রী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে সাম্প্রতিক গুলি চালানোর ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। কনস্যুলেট সমস্ত ভক্ত এবং সম্প্রদায়ের প্রতি পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ করে এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে তৎপর হওয়ার আহ্বান জানায়।” ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালও এই ধরনের ঘটনাকে ‘জঘন্য’ বলে বর্ণনা করেছেন এবং মন্দিরগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
We strongly condemn the recent firing incident at the ISKCON Sri Sri Radha Krishna temple in Spanish Fork, Utah. The Consulate extends full support to all the devotees and the community and urges the local authorities to take prompt action to bring the perpetrators to justice.…
— India in SF (@CGISFO) July 1, 2025
চিনো হিলসে ব্যাপস মন্দিরে ভাঙচুর
এই বছরের ৯ মার্চ, ক্যালিফোর্নিয়ার চিনো হিলসে অবস্থিত ব্যাপস শ্রী স্বামীনারায়ণ মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই মন্দির, যা ক্যালিফোর্নিয়ার বৃহত্তম হিন্দু মন্দির হিসেবে পরিচিত, লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি তথাকথিত ‘খালিস্তানি গণভোট’-এর ঠিক আগে ভাঙচুরের শিকার হয়। নিরাপত্তা ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, দুজন ব্যক্তি মন্দিরের প্রবেশপথের সাইনবোর্ড এবং ফুটপাথে স্প্রে পেইন্ট দিয়ে ‘হিন্দুস গো ব্যাক’, ‘এফ— মোদি’ এবং ‘হিন্দুস্তান’ লিখেছে। এই ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫,০০০ ডলার। সান বার্নার্ডিনো কাউন্টি শেরিফের বিভাগ তদন্ত শুরু করেছে, তবে এখনও কোনো গ্রেপ্তার হয়নি।
ব্যাপস পাবলিক অ্যাফেয়ার্স তাদের এক্স পোস্টে বলেছে, “চিনো হিলসে আরেকটি মন্দির ভাঙচুরের মুখে হিন্দু সম্প্রদায় ঘৃণার বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছে। আমরা কখনোই ঘৃণাকে শিকড় গাড়তে দেব না। আমাদের সাধারণ মানবতা এবং বিশ্বাস শান্তি ও সমবেদনার জয় নিশ্চিত করবে।”
কোহনার ভূমিকা এবং হিন্দুবিরোধী ঘৃণার উত্থান
কোয়ালিশন অফ হিন্দুস অফ নর্থ আমেরিকা (কোহনা) এই ঘটনাগুলোকে হিন্দুবিরোধী ঘৃণার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সঙ্গে যুক্ত করেছে। তারা এক্স-এ পোস্ট করে বলেছে, “আরেকটি হিন্দু মন্দির ভাঙচুরের শিকার হয়েছে, এবার চিনো হিলসের আইকনিক ব্যাপস মন্দির। এটা অবাক করার মতো নয় যে লস অ্যাঞ্জেলেসে তথাকথিত ‘খালিস্তানি গণভোট’-এর দিন যত কাছে আসছে, এই ঘটনা ঘটছে।” তারা ২০২২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ১০টি মন্দিরে ভাঙচুর বা চুরির ঘটনার তালিকা প্রকাশ করেছে এবং এই ঘটনাগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
কোহনা আরও উল্লেখ করেছে যে, ক্যালিফোর্নিয়ায় হিন্দুবিরোধী ঘৃণা-অপরাধ ধর্মীয় পক্ষপাতের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ, যা মোট ধর্মীয় ঘৃণা-অপরাধের ২৩.৩%। এটি ইহুদিবিরোধী ঘৃণা-অপরাধের (৩৭%) পরে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।
অন্যান্য ঘটনা এবং প্রেক্ষাপট
গত বছর, ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোতে ব্যাপস শ্রী স্বামীনারায়ণ মন্দিরে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে, যেখানে ‘হিন্দুস গো ব্যাক’ লেখা গ্রাফিতি পাওয়া যায়। এই ঘটনার মাত্র ১০ দিন আগে নিউ ইয়র্কের মেলভিলে আরেকটি ব্যাপস মন্দিরে একই ধরনের ভাঙচুর হয়েছিল। এই ঘটনাগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে গভীর ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
এই হামলাগুলোর সময় ‘খালিস্তানি গণভোট’-এর সঙ্গে সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে, যা ভারতের পাঞ্জাবে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি অ-বাধ্যতামূলক ভোট। কোহনা এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠন এই ঘটনাগুলোকে খালিস্তানি উগ্রবাদের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যা হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছে বলে তারা মনে করে।
আমেেরিকার হিন্দু মন্দিরগুলোর উপর ক্রমবর্ধমান হামলা এবং ভাঙচুর হিন্দুবিরোধী ঘৃণার একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা প্রকাশ করছে। স্প্যানিশ ফোর্কের ইসকন মন্দিরে গুলি চালানো এবং চিনো হিলসের ব্যাপস মন্দিরে ভাঙচুর এই সমস্যার সাম্প্রতিক উদাহরণ। ভারত সরকার এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সংগঠনগুলো এই ঘটনাগুলোর তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য তদন্তের দাবি জানিয়েছে। এই ঘটনাগুলো ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং সহাবস্থানের মূল্যবোধের উপর প্রশ্ন তুলছে, এবং হিন্দু সম্প্রদায় শান্তি ও ঐক্যের মাধ্যমে এই ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে।