ভারত ও আফগানিস্তানের (India Afghanistan Pharma MoU) মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর করার পথে বড় পদক্ষেপ নেওয়া হল স্বাস্থ্য খাতে। দুই দেশের মধ্যে ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরে ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা স্মারক (MoU) সই হয়েছে, যা শুধু আফগানিস্তানের ওষুধ শিল্পের উন্নয়নেই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতেও একটি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের জন্য এটি বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ বহু বছর ধরে আফগানিস্তানের বাজারে নকল বা নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহে পাকিস্তানি কোম্পানিগুলির প্রভাব ছিল।
এই চুক্তিটি হয়েছে আফগানিস্তানের Raoufi Global Group এবং ভারতের শীর্ষস্থানীয় ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা Zydus Lifesciences Limited–এর মধ্যে। সমঝোতা স্মারকটি সই করেন আফগান দূতাবাস, দুবাইয়ে আফগান কনসুলেট এবং আফগান বাণিজ্যিক প্রতিনিধিরা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হজরত নামে পরিচিত আফগানিস্তানের এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য-সম্পর্কিত ব্যক্তিত্ব। আফগান পক্ষের মতে, এই MoU শুধু একটি বাণিজ্যিক সমঝোতা নয়, বরং আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য খাতকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার একটি কৌশলগত পদক্ষেপ।
সমঝোতা অনুযায়ী, ভারত এখন থেকে আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, আসল এবং নিয়মিত সরবরাহযোগ্য ওষুধ পাঠাবে। বহু বছর ধরে তালিবান-শাসিত আফগানিস্তান এবং তার আগের যুদ্ধবিধ্বস্ত সময়গুলোতে আফগান বাজারে নিম্নমানের, নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের প্রাধান্য দেখা গেছে। চিকিৎসা খাতের দুর্বলতা এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে সাধারণ মানুষ এর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী। ভারতের সঙ্গে এই ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি আফগানিস্তানকে সেই অচল অবস্থা থেকে বের করে আনার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
MoU অনুযায়ী, আফগানিস্তান ও ভারতের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা ও ঔষধ শিল্পে প্রযুক্তিগত সমন্বয় আরও জোরদার করা হবে। আফগানিস্তানের নিজস্ব ওষুধ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর টেকনিক্যাল ক্যাপাসিটি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে ভারতের সহায়তায়। এর ফলে ভবিষ্যতে আফগানিস্তান শুধু ভালো মানের ওষুধই পাবে না, বরং ধীরে ধীরে নিজস্ব উৎপাদন লাইন দাঁড় করাতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এই উদ্যোগ দেশটির স্বাস্থ্যক্ষেত্রে “গুণগত পরিবর্তনের সূচনা” করবে। দেশের ভাঙাচোরা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যেখানে যথাযথ মানের ওষুধ পাওয়া অনেক সময়ই কঠিন, সেখানে ভারতের মতো একটি নির্ভরযোগ্য ফার্মাসিউটিক্যাল শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া আফগান নাগরিকদের জন্য আশার আলো।
চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য হল আফগানিস্তানকে নকল ও নিম্নমানের ওষুধের ওপর নির্ভরতা থেকে মুক্তি দেওয়া। বর্তমানে আফগানিস্তানের বাজারে পাকিস্তান থেকে আসা ওষুধের বড় একটি অংশ ‘কপি’ বা ‘সাবস্ট্যান্ডার্ড’ বলে অভিযোগ আছে। এর ফলে চিকিৎসার কার্যকারিতা কমে এবং মানুষের স্বাস্থ্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ভারতের সঙ্গে এই নতুন MoU-কে অনেক আফগান বিশেষজ্ঞ সরাসরি পাকিস্তানের ওপর নির্ভরতা কমানোর ব্যাপার হিসেবে দেখছেন। রাজনৈতিকভাবেও এটি পাকিস্তানের জন্য একটি কৌশলগত ধাক্কা, কারণ দক্ষিণ এশিয়ার ফার্মা বাজারে ভারতের প্রভাব আগেই ছিল এবং এখন আফগানিস্তানের বড় অংশের ওষুধ সরবরাহও ভারতই করবে।
দুবাইয়ে আফগানিস্তানের জেনারেল কনসুলেট এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, “এই চুক্তি আমাদের দেশের চিকিৎসা পরিষেবার মান উন্নত করার একটি বড় পদক্ষেপ। এর ফলে চিকিৎসা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ হবে এবং নাগরিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাস্তব ও কার্যকর পরিবর্তন আসবে।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আফগান জনগণের জন্য গুণগত মানের ওষুধ নিশ্চিত করা আমাদের অগ্রাধিকার। এই MoU ভবিষ্যতের উন্নত আফগানিস্তান গঠনের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ।”
এদিকে আফগান বণিক মহলও এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। তাঁরা বলছেন, ভারতের ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্প বিশ্বে অন্যতম নির্ভরযোগ্য এবং এই অংশীদারিত্ব আফগানিস্তানকে আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা ও ওষুধ পাওয়ার সুযোগ করে দেবে। একই সঙ্গে আফগান ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যতে এমন আরও কৌশলগত অংশীদারিত্বকে সমর্থন করবেন বলে জানিয়েছেন।
এই চুক্তির ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বও কম নয়। আফগানিস্তান বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। তালিবান প্রশাসন রাজনৈতিক স্বীকৃতি না পেলেও ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বজায় রেখেছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে, সীমান্ত সংঘর্ষ থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে অভিযোগ,সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত। এই প্রেক্ষাপটে ভারত-আফগানিস্তানের ১০০ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ চুক্তি পাকিস্তানের অবস্থানকে দুর্বল করবে বলেই মনে করছেন কূটনৈতিক মহল।
সব মিলিয়ে, দুই দেশের মধ্যে এই MoU শুধু একটি ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, এটি আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য খাতে ‘গুণগত বিপ্লব’-এর সূচনা এবং একই সঙ্গে ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর আরেকটি বড় পদক্ষেপ। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের কাছে এটি জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি, আর বৃহত্তর ভূ-রাজনীতিতে এটি দক্ষিণ এশিয়ার শক্তির ভারসাম্যে একটি নতুন সুর।
