মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প (Donald Trump ) সোমবার একটি ঐতিহাসিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, যার মাধ্যমে সিরিয়ার উপর আরোপিত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা (Syria Sanctions) কর্মসূচির অবসান ঘটেছে। এই পদক্ষেপ সিরিয়াকে আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটিয়ে ১৩ বছরের বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের পর দেশটির পুনর্গঠনের জন্য ওয়াশিংটনের প্রতিশ্রুতিকে শক্তিশালী করেছে। হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লিভিট সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এই আদেশ সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ, তাঁর সহযোগী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, মাদক পাচারকারী, রাসায়নিক অস্ত্রের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি, আইএসআইএস এবং এর সহযোগী এবং ইরানের প্রক্সিদের উপর নিষেধাজ্ঞা বহাল রাখবে।
গত ডিসেম্বরে ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের নেতৃত্বে বাশার আল-আসাদের শাসনের অবসান ঘটে, এবং তারপর থেকে সিরিয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে চলেছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদ আল-শিবানি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এ এক পোস্টে বলেছেন, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ “দীর্ঘ প্রতীক্ষিত পুনর্গঠন ও উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করবে” এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের পথে বাধা দূর করবে।
ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন এবং রিয়াদে সাক্ষাৎ
গত মে মাসে সৌদি আরবের রিয়াদে সিরিয়ার নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ হয়, যেখানে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে সিরিয়ার উপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। এই সিদ্ধান্ত ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন, যা সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের পরামর্শের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছিল। ট্রাম্প বলেছিলেন, “সিরিয়া অনেক দুর্যোগ, যুদ্ধ এবং হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে গেছে। এখন তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের সুযোগ দেওয়ার সময়।”
এই ঘোষণার পর মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ মে মাসে একটি সাধারণ লাইসেন্স (জিএল ২৫) জারি করে, যা সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকার, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে লেনদেনের অনুমতি দেয়। এছাড়াও, পররাষ্ট্র বিভাগ সিজার সিরিয়া সিভিলিয়ান প্রোটেকশন অ্যাক্টের অধীনে ১৮০ দিনের জন্য নিষেধাজ্ঞা মওকুফ করে।
সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য নতুন সম্ভাবনা
সিরিয়ার জনগণ আশা করছে যে নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণ মানবিক সংস্থাগুলির বৃহত্তর অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করবে এবং বিদেশী বিনিয়োগ ও বাণিজ্যকে উৎসাহিত করবে। সিরিয়ার অর্থনীতি গত ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের ফলে সিরিয়ার পুনর্গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব হবে।
হোয়াইট হাউসের একটি ফ্যাক্ট শিটে বলা হয়েছে, এই নির্বাহী আদেশ পররাষ্ট্র সচিবকে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর সন্ত্রাসী সংগঠনের মর্যাদা এবং সিরিয়াকে সন্ত্রাসের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষক হিসেবে মর্যাদা পর্যালোচনার নির্দেশ দেয়। এইচটিএস হলো আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী গোষ্ঠী, যার আল-কায়েদার সঙ্গে পূর্বের সম্পর্ক ছিল। আল-শারা ২০১৬ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এবং এখন একটি বাস্তববাদী ও জাতীয়তাবাদী শাসনব্যবস্থার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছেন।
নিষেধাজ্ঞার স্তর এবং চ্যালেঞ্জ
মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলির মধ্যে অনেকগুলি ২০১১ সালে বাশার আল-আসাদের সরকার এবং মূল ব্যক্তিদের উপর আরোপিত হয়েছিল, যখন সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। ২০১৯ সালে সিজার অ্যাক্টের মাধ্যমে আরো কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, যা তৃতীয় দেশের কোম্পানি ও সরকারগুলির উপরও প্রভাব ফেলে। এই নিষেধাজ্ঞাগুলি সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহারের জন্য কংগ্রেসের অনুমোদন প্রয়োজন, যদিও প্রেসিডেন্ট জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সাময়িক মওকুফ করতে পারেন।
মার্কিন বিশেষ দূত টমাস ব্যারাক বলেছেন, এই নির্বাহী আদেশ “নিষেধাজ্ঞা খোলার একটি জটিল প্রক্রিয়ার পরিণতি।” তিনি আরও বলেন, এটি সিরিয়ার নতুন সরকারকে স্থিতিশীলতা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ দেবে। তবে, কিছু মার্কিন কংগ্রেস সদস্য এই নিষেধাজ্ঞা পুরোপুরি তুলে নেওয়ার পক্ষে থাকলেও, অন্যরা এটিকে ধীরে ধীরে এবং শর্তসাপেক্ষে করার পক্ষে।
ইউরোপের পদক্ষেপ এবং আঞ্চলিক প্রভাব
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং যুক্তরাজ্যও সিরিয়ার উপর থেকে তাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। ইইউ ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা শুরু করে এবং ২৮ মে তারিখে বেশিরভাগ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। যুক্তরাজ্যও মার্চ ২০২৫ থেকে সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়। এই সমন্বিত পদক্ষেপ সিরিয়ার অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে সহায়তা করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ
সিরিয়ার নতুন সরকারের সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দেশটির অর্থনীতি ধ্বংসপ্রাপ্ত, এবং জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণের ফলে সিরিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে লেনদেন সম্ভব হবে, যা পুনর্গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এইচটিএস-এর সন্ত্রাসী সংগঠনের মর্যাদা এবং সিরিয়ার সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রের তালিকা থেকে অপসারণের বিষয়টি এখনও পর্যালোচনাধীন।
ট্রাম্প প্রশাসন সিরিয়ার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে, বিশেষ করে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকৃতি, বিদেশী সন্ত্রাসীদের বিতাড়ন এবং ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিষিদ্ধকরণের মতো বিষয়ে। ইসরায়েলের কিছু কর্মকর্তা আল-শারার প্রশাসনের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করলেও, ট্রাম্পের এই পদক্ষেপ মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সিরিয়ার জন্য একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এই পদক্ষেপ দেশটির অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। তবে, এই প্রক্রিয়া জটিল এবং সময়সাপেক্ষ, এবং সিরিয়ার নতুন সরকারের উপর নির্ভর করবে তারা কীভাবে এই সুযোগ কাজে লাগায়। বাংলার ফুটবল প্রেমীদের মতো, যারা ডায়মন্ড হারবার এফসি’র উত্থানে নতুন সম্ভাবনা দেখে, সিরিয়ার জনগণও এই নতুন শুরুর মাধ্যমে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা করছে।