জুলাই সনদ কার্যকর করার দাবিতে টানা অবস্থান কর্মসূচি চলছে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ শুক্রবারও অব্যাহত রয়েছে, যার ফলে রাজধানীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই সড়ক মোড়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজট। সাধারণ মানুষ এবং যাত্রীরা এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো।
প্রতিদিন হাজারো মানুষ যাতায়াত করেন শাহবাগ এলাকা দিয়ে। কিন্তু বৃহস্পতিবার থেকে কয়েকশ প্রতিবাদকারী শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিক যান চলাচল। আন্দোলনকারীরা স্লোগান দেন — “জুলাই নিয়ে তালবাহানা, চলবে না, চলবে না” এবং “জুলাই সনদ দিতে হবে, দিতে হবে”।
আন্দোলনকারীদের দাবিগুলি কী?
আন্দোলনকারীরা বলছেন, জুলাই মাসের মধ্যেই যেসব সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেগুলোর ভিত্তিতে “জুলাই সনদ” প্রকাশ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন (NCC) যে আলোচনার আয়োজন করেছে, তাতে ইতিমধ্যে অধিকাংশ দল একমত হলেও, বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলো ছয়টি প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে।
প্রতিবাদকারীদের একজন সংবাদ সংস্থা ইউএনবি-কে বলেন, “আমরা আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত রাস্তায় থাকব। যত দিন লাগুক, অবস্থান কর্মসূচি চলবে।”
অচল হয়ে পড়েছে শহরের বিভিন্ন এলাকা
বিক্ষোভকারীদের এই অবস্থান কর্মসূচির ফলে রাজধানীর শাহবাগ, বাংলামোটর, কারওয়ান বাজার, সায়েন্স ল্যাব, নীলক্ষেত এবং আশেপাশের এলাকাগুলোর রাস্তায় দীর্ঘ যানজট তৈরি হয়েছে। এক যাত্রী বলেন, “সকালবেলা অফিসের কাজে যাত্রাবাড়ী থেকে বের হয়েছিলাম। শাহবাগে অবরোধ হয়েছে শুনে বাসে করে বাসাবো, কমলাপুর হয়ে মালিবাগ দিয়ে ঘুরপথে কারওয়ান বাজার পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সব জায়গায় একই অবস্থা — জ্যাম আর জ্যাম। এক ঘণ্টার পথ যেতে সময় লেগেছে আড়াই ঘণ্টার বেশি।”
এনসিসির দ্বিতীয় দফা সংলাপ ও রাজনৈতিক মতভেদ:
গত বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (NCC) দ্বিতীয় দফা সংলাপ। এতে অংশ নিয়েছে ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দল। এনসিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. আলী রিয়াজ সাংবাদিকদের জানান, “আমাদের লক্ষ্য ছিল ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আলোচনা শেষ করা, এবং আমরা তা সফলভাবে সম্পন্ন করেছি। এখন আমরা পূর্ণাঙ্গ ‘জুলাই সনদ’ প্রস্তুত করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ভাগ করে নেব।”
তিনি আরও বলেন, “আজ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সাতটি সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে। তবে বিএনপি ও কিছু মিত্র দল ছয়টি প্রস্তাবে আপত্তি তুলেছে।”
বিএনপি ও মিত্র দলগুলোর আপত্তি কী?
সংসদীয় পদ্ধতির সংস্কার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, একটি উচ্চকক্ষ গঠন, এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে যেসব সংস্কার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তার অনেকগুলোতেই বিএনপি ও ইসলামি দলগুলোর আপত্তি রয়েছে।
তারা দাবি করেছে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত নতুন সরকার যেন এই সংস্কার প্রস্তাবনা বাস্তবায়নে বিলম্ব না করে এবং এই সনদ আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হোক, যাতে তা কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে।
জুলাই সনদের পটভূমি ও রাজনৈতিক বিভাজন
জুলাই সনদের মূল লক্ষ্য ছিল দেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন এবং একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সংলাপগুলোয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পেছনে যুক্ত দলগুলোই এবার পরস্পরবিরোধিতায় লিপ্ত হয়েছে।
এই সব দল, বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (NCP), ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ — প্রাথমিকভাবে এনসিসি’র সঙ্গে একযোগে কাজ করলেও, এখন জুলাই সনদের খসড়া নিয়ে স্পষ্ট মতভেদ প্রকাশ করেছে।
তারা অভিযোগ করেছে যে সনদের বাস্তবায়নের জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা (দুই বছর) দেয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়, বরং এটি যেন সংবিধান বা একটি পৃথক আইন হিসেবে গৃহীত হয়।
পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে?
এনসিসি সূত্র জানায়, এখন তাদের লক্ষ্য জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো এবং তাদের মন্তব্য নিয়ে একপ্রকার ঐকমত্যে পৌঁছানো। যদিও বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর অবস্থান এখনও অনড়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন যদি আইনি কাঠামোতে না আসে, তাহলে এটি একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তাতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।”
এদিকে, শাহবাগে অবস্থান নেওয়া আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা পিছু হটবেন না। ফলে আগামী দিনে রাজধানীতে যানচলাচল আরও বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকেও এখনো কোনও দৃশ্যমান হস্তক্ষেপ না থাকায় পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।