কেন মুজিবুর রহমান খুন? Kolkata 24×7 প্রকাশ করছে সিরিজ। এই সিরিজের মূল লক্ষ্য, মুজিব হত্যার নেপথ্য অংশগুলি দেখা। (The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman)
প্রসেনজিৎ চৌধুরী: রাজপথে উত্তাল জনপ্লাবনের ঢেউয়ের সম্মুখভাগ ততক্ষণে বাংলাদেশের সংসদ ভবনের দখল নিয়েছে। লাখ লাখ জনতার ক্ষোভের মুখে দেশ ছেড়ে চলে গেছেন শেখ হাসিনা। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা শহরের পরিস্থিতি এমন। রাজপথে, দেয়ালে অজস্র গ্রাফিতিতে বিদ্রোহের আহ্বানের পাশাপাশি দেখা যাচ্ছিল কালো কালিতে লেখা ‘সিরাজ শিকদার হত্যার তদন্ত চাই’।
সিরাজ শিকদারের মৃত্যু রহস্য The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman
মৃত্যুর পাঁচ দশক পরেও নকশালপন্থী নেতা সিরাজ শিকদারের মৃত্যু রহস্য থেকে গেছে। তার মৃত্যু ‘রাষ্ট্রের মদতে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ ও গুমখুন বলে বাংলাদেশে বারবার সঠিক তদন্তের দাবি উঠেছে। একাধিক রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত সিরাজ শিকদারের গুলিবিদ্ধ দেহ মিলেছিল ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে। তাকে পুলিশি হেফাজতে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। নথিভুক্ত মৃত্যুর তারিখ ২ জানুয়ারি, ১৯৭৫ সাল।
কলকাতায় নকশাল নেতা সরোজ দত্ত ও ঢাকায় সিরাজ শিকাদরের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যবধান চার বছর। দুজনেরই গুলিতে মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর আগে দুজনই বন্দি হয়েছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman
সিরাজ শিকদারের অস্বাভাবিক মৃত্যুর সাত মাসের মাথায় বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের এই সেনা অভ্যুত্থানে জড়িত অফিসাররা কয়েকজন অতি বামপন্থী রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন বলে বিভিন্ন সময় তথ্য উঠে এসেছে। সিরাজ শিকদারের সশস্ত্র রাজনীতির প্রতি অনুরক্তরা পরে এমন তথ্য দিয়েছেন। তারাই স্পষ্ট জানান, সিরাজ শিকদারও সন্দেহবাতিক ছিলেন। এই কারণে বেশকিছু নির্দোষ দলীয় কর্মীর মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল।
“জনগণ যেন জল/ গেরিলারা মাছের মত সাঁতারায়…”
সশস্ত্র রাজনীতির কোনো এক সময় এমনই লিখেছিলেন সিরাজ শিকদার। পথের ধারে পড়ে থাকা তাঁর গুলিবিদ্ধ দেহের সামনে ‘সর্বহারা পার্টি’র রাষ্ট্র বিরোধী সশস্ত্র রাজনীতি শেষ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুম-খুন The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman
বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুম-খুন চর্চিত শব্দ। সিরাজ শিকদারের রাজনীতির চরম বিরোধীরাও স্বীকার করেন শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনেই এই রাজনৈতিক গুম-খুন তত্ত্বটি প্রশাসনে জেঁকে বসেছিল। সে এক বিতর্কিত পরিস্থিতি। খোদ সেনা অফিসার শরিফুল হক ডালিমের স্ত্রীকেই গুম (অপহরণ) করে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে গেল।
শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তান সেনার অফিসার ছিলেন। ১৯৭১ সালে গোপনে সেনাবাহিনী ত্যাগ করেছিলেন। পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পার করে ভারতে এসে যোগ দেন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীতে। পরে বাংলাদেশ তৈরির পর হন সে দেশের সেনা অফিসার। স্ত্রীকে অপহরণ করার ঘটনাটি তিনি নিজেই লিখেছেন। ‘মেজর ডালিম বলছি’ বই থেকে সেই রোমহর্ষক অপহরণ বিবরণটি থাকল- ” রেডক্রস চেয়ারম্যান এবং তদানীন্তন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ প্রধান গাজী গোলাম মোস্তফা নিম্নী এবং আমাকে বন্দুকের মুখে লেডিস ক্লাব থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়।”
অভিযুক্ত গাজী গোলাম মোস্তাফার রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রবল প্রভাব ছিল। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সেই সুবাদে গাজী গোলাম রেডক্রশের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশের পদাধিকারী হয়েছিলেন। বিতর্কিত গাজী গোলাম মোস্তাফা। সে ও তার সাগরেদরা বন্দুক দেখিয়ে সেনা অফিসারের স্ত্রীকে তুলে নিয়ে ঢাকার রাস্তায় প্রবল বেগে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। তার গাড়ির পিছনে আর একটা গাড়িতে সশস্ত্র সেনা অফিসাররা তীক্ষ্ম নজর রাখছেন। এমন দৃশ্য একেবারে মারকাটারি সিনেমার মতো। ১৯৭৪ সালের সেই রাতে ঢাকার রাজপথ অনেক আগেই আরও একটি সিনেমার কারণে ফাঁকা হয়ে গেছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশনে দেখানো হচ্ছিল সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’।
চরম নাটকীয় অপহরণ The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman
এই চরম নাটকীয় অপহরণের বিষয়ে শরিফুল হক ডালিমের দাবি, পারিবারিক বিয়ের অনুষ্ঠানে গাজী গোলাম মোস্তফার পরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে আমার শ্যালকের বচসা থেকে যাবতীয় ঘটনার সূত্রপাত। বিয়ের অনুষ্ঠানে আচমকা হাজির হয়ে গাজী গোলাম মোস্তাফা ও তার সাগরেদরা আমাদের বন্দুক দেখিয়ে গাড়িতে তুলে নেয়। প্রকাশ্যে এমন অপহরণের সংবাদ দ্রুত ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেটি জানতে পারেন।
এই অপহরণের সমাপ্তি ঘটে খোদ প্রধানমন্ত্রীর ঘরে এমনই দাবি করেছেন সেনা অফিসার ডালিম। তিনি লিখেছেন, শেখ সাহেবের কামরায় তখন আমি, নিম্মী আর গাজী ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। নিম্মী দুঃখে-গ্ল্যানিতে কান্নায় ভেঙে পড়ল। শেখ সাহেব ওকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিলেন। অদূরে গাজী ভেজা বেড়ালের মত কুকড়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছিল।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। রেড ফোন। শেখ সাহেব নিজেই তুলে নিলেন রিসিভার। গাজীর বাসা থেকে ফোন এসেছে। বাসা থেকে খবর দিল আর্মি গাজীর বাসা রেইড করে সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে। শুধু তাই নয় সমস্ত শহরে আর্মি চেকপোস্ট বসিয়ে প্রতিটি গাড়ি চেক করছে। ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিডন্যাপিং এর খবর পাওয়ার পরপরই ইয়ং-অফিসাররা যে যেখনেই ছিল সবাই বেরিয়ে পড়েছে এবং খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিম্মীকে। সমস্ত শহরে হৈচৈ পড়ে গেছে। গাজীরও কোনো খবর নেই। গাজীকে এবং তার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদেরও খুঁজছে আর্মি তন্নতন্ন করে সম্ভাব্য সব জায়গায়।
টেলিফোনে কী বার্তা The story behind the assassination of Sheikh Mujibur Rahman
টেলিফোন পাওয়ার পর শেখ সাহেবের মুখটা কালো হয়ে গেল। ফোন পেয়েই তিনি আমাদের সামনেই আর্মি চিফ শফিউল্লাহকে হটলাইনে বললেন, – ডালিম, নিম্মী, গাজী সবাই আমার এখানে আছে। তুমি জলদি চলে আসো আমার এখানে। ফোন রেখে শেখ সাহেব গাজীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, -মাফ চা নিম্মীর কাছে। গাজী শেখ সাহেবের হুকুমে নিম্মীর দিকে এক পা এগুতেই সিংহীর মত গর্জে উঠল নিম্মী, -খবরদার! তোর মতো ইতর লোকের মাফ চাইবার কোনো অধিকার নাই; বদমাইশ।
এরপর শেখ মুজিবের দিকে ফিরে বলল নিম্মী, -কাদের রক্তের বদলে আজ আপনি প্রধানমন্ত্রী? আমি জানতে চাই। আপনি নিজেকে জাতির পিতা বলে দাবি করেন। আমি আজ আপনার কাছে বিচার চাই। আজ আমার জায়গায় শেখ হাসিনা কিংবা রেহানার যদি এমন অসম্মান হতো, তবে যে বিচার আপনি করতেন আমি ঠিক সেই বিচারই চাই। যাদের রক্তের বিনিময়ে আজ আপনারা জাতির কর্ণধার হয়ে ক্ষমতা ভোগ করছেন সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান ভুলুন্ঠিত করে তাদের গায়ে হাত দেয়ার মতো সাহস কম্বলচোর গাজী পায় কী করে? এর উপযুক্ত জবাব আমি আজ চাই আপনার কাছ থেকে। আজ পর্যন্ত আপনি বলতে পারবেন না ব্যক্তিগতভাবে কোনো কিছু চেয়েছি আপনার কাছে, কিন্তু আজ দাবি করছি ন্যায্য বিচার। আপনি যদি এর বিচার না করেন, তবে আমি আল্লাহর কাছে এই অন্যায়ের বিচার দিয়ে রাখলাম। তিনি নিশ্চয়ই এর বিচার করবেন।
আমি অনেক চেষ্টা করেও সেদিন নিম্মীকে শান্ত করতে পারিনি। ঠান্ডা মেজাজের কোমল প্রকৃতির নিম্মীর মধ্যেও যে এ ধরনের আগুন লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটা আমার কাছেও আশ্চর্য লেগেছিল সেদিন। শেখ সাহেব নিম্মীর কথা শুনে ওকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলেছিলেন, -মা, তুই শান্ত হ। হাসিনা-রেহানার মতো তুইও আমার মেয়েই। আমি নিশ্চয়ই এর উপযুক্ত বিচার করব। অন্যায়! ভীষণ অন্যায় করছে গাজী, কিন্তু তুই মা শান্ত হ। বলেই রেহানাকে ডেকে তিনি নিম্মীকে উপরে নিয়ে যেতে বললেন। (বানান অপরিবর্তিত)
কে নিম্মী? ডালিম ও নিম্মীর সঙ্গে কলকাতার অনেক কথা জড়িয়ে আছে। (ক্রমশ)
গত পর্ব: মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্র-৩: দরজা বন্ধ করেই নিঃসঙ্গ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর ইঙ্গিত মুজিব খুন হবেন!