তিস্তার জলের জন্য তীব্র হচ্ছে প্রতিবাদ! বাংলাদেশকে ইন্ধন চিনের

teesta-river-protest-bangladesh-china-support-2025

ঢাকা: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের সামনে হাজারো ছাত্র-ছাত্রী মশাল জ্বালিয়ে মানববন্ধন গড়ে তুলেছে। হাতে প্ল্যাকার্ড, মুখে স্লোগান‘তিস্তা বাঁচাও, জল ন্যায় চাও’। এটি কোনো সাধারণ সমাবেশ নয়, এটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষক-শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের প্রকাশ। অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে রংপুর বিভাগের পাঁচটি জেলায় টর্চ মার্চ, সাইলেন্ট প্রটেস্ট, সিট-ইন সবই একই দাবি নিয়ে চীন-সমর্থিত তিস্তা মাস্টার প্ল্যানের অবিলম্বে বাস্তবায়ন।

Advertisements

এই আন্দোলন শুধু জলের লড়াই নয়, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রতীক হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর পেছনে ভারত-বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী জলবিবাদ এবং চীনের কৌশলগত হস্তক্ষেপ যা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিকে নতুন মোড় দিচ্ছে।তিস্তা নদী, হিমালয়ের সিকিম থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।

লঞ্চের আগেই উন্মোচিত 2026 Hyundai Venue, অল্প টাকায় করুন বুকিং

এর মোট দৈর্ঘ্য ৪১৪ কিলোমিটার, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের অংশ। এই নদী উত্তর বাংলাদেশের কৃষির মেরুদণ্ড। লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা এই জেলাগুলোর প্রায় ২ কোটি মানুষ তিস্তার জলে নির্ভরশীল। বর্ষায় এটি বন্যার কারণ হয়ে ওঠে, তীরভূমি ক্ষয় হয়, ফসল ধ্বংস হয়। শুষ্ককালে আবার জলের প্রবাহ কমে যায় কৃষকরা ধান চাষ করতে পারে না, জলের সংকটে দৈনন্দিন জীবন বিপর্যস্ত।

এর জন্য দায়ী ভারতের উজানে গজলডোবা বাঁধ এবং অন্যান্য সেচ প্রকল্প, যা শুষ্ক মাসে জল ধরে রাখে। ২০১১ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ৩৭.৫% জল ভাগাভাগির চুক্তি হয়তো হয়ে যেত, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির বিরোধিতায় তা আটকে যায়। ফলে, ১৪ বছর ধরে এই বিবাদ অমীমাংসিত। বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদনের ৩০% ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে এটি আরও তীব্র হচ্ছে।

এখন চীনের প্রবেশ এই সংকটকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের স্টেট-ওনড পাওয়ারচায়না কোম্পানি বাংলাদেশের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাথে একটি অ-বাধ্যতামূলক চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারা ১ বিলিয়ন ডলারের তিস্তা কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রজেক্টের মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নদীখাত গভীরকরণ, বাঁধ নির্মাণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, তীরভূমি সুরক্ষা, এমনকি উপগ্রহ শহর এবং শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা।

Advertisements

চীনের মতে, এটি বর্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ করবে, শুষ্ককালে জল সংরক্ষণ করে সেচ সুবিধা দেবে। ২০২৫ সালের মার্চে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনুসের চীন সফরে এই প্রকল্পটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়। ইউনুস চীনকে ‘জল ব্যবস্থাপনার মাস্টার’ বলে অভিহিত করে ৫০ বছরের মাস্টার প্ল্যান চেয়েছেন।

চীন ২.১ বিলিয়ন ডলারের ঋণ, বিনিয়োগ এবং অনুদান দিয়েছে, যার মধ্যে তিস্তা প্রকল্পের জন্য ৬৭০০ কোটি টাকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালে কাজ শুরু হবে, ২০২৯ সালের মধ্যে সম্পন্ন। এটি উত্তর বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে বিপ্লবী পরিবর্তন আনতে পারে কৃষি উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান তৈরি হবে, পরিবেশ রক্ষা হবে।

কিন্তু ভারতের জন্য এটি লাল সংকেত। তিস্তা প্রকল্পটি শিলিগুড়ি করিডরের ভারতের ‘চিকেনস নেক’-এর কাছাকাছি। এই ২২ কিলোমিটার প্রশস্ত স্থলখণ্ড উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোকে ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে যুক্ত করে। চীনের হস্তক্ষেপ এখানে নজরদারি বাড়াতে পারে, যা ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনা কর্মী বা পরিকাঠামো সীমান্তের কাছে থাকলে এটি ভারত-চীনের শক্তিসংগ্রামকে আরও তীব্র করবে।

২০২৪ সালে শেখ হাসিনার সরকার ভারতকে এই প্রকল্পের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, কিন্তু জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চীনের দিকে ঝুঁকেছে। বিএনপি এই আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যা আসন্ন নির্বাচনের আগে জনমত গড়ে তুলছে।

ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া প্রটেস্টগুলোতে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমেছে ফেব্রুয়ারিতে ১৩০ কিলোমিটার সিট-ইন, অক্টোবরে ১০৫ কিলোমিটার টর্চ মার্চ। ছাত্ররা বলছে, “তিস্তা শুকিয়ে যাচ্ছে, আমাদের জীবন শুকোচ্ছে। ভারত যদি বন্ধু হয়, তাহলে জল দিন।”