‘মিলিট্যান্ট নেতা, দেশকে আমেরিকার কাছে বিক্রি করছে’- ইউনূসকে তোপ হাসিনার

বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। তিনি নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদকে “মিলিট্যান্ট নেতা” হিসেবে আখ্যায়িত…

Sheikh Hasina Accuses Muhammad Yunus

বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’ শেখ হাসিনা (Sheikh Hasina) রবিবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। তিনি নোবেল বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদকে “মিলিট্যান্ট নেতা” হিসেবে আখ্যায়িত করে অভিযোগ করেছেন যে, তিনি “দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করছেন” এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীর সমর্থনে ক্ষমতা দখল করেছেন। আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত একটি অডিও বার্তায় এই মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন উত্তেজনার জন্ম দিয়েছে।

২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র নেতৃত্বাধীন ব্যাপক বিক্ষোভের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। তার এই বক্তব্য এমন এক সময়ে এলো, যখন মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশের সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশ বাড়ছে। সেনাপ্রধান এই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছেন, যখন ইউনূস এই চাপের জবাবে পদত্যাগের হুমকি দিয়েছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা এই রাজনৈতিক সংকট এবং শেখ হাসিনার অভিযোগের বিশদ বিশ্লেষণ উপস্থাপন করব।

   

শেখ হাসিনার অভিযোগ: ইউনূসের বিরুদ্ধে গুরুতর দাবি
শেখ হাসিনা তার অডিও বার্তায় মুহাম্মদ ইউনূসের উপর তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “আমার বাবা (শেখ মুজিবুর রহমান) সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জন্য আমেরিকার দাবি মেনে নেননি। এর জন্য তাকে জীবন দিতে হয়েছিল। আমি কখনোই ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশ বিক্রির কথা ভাবিনি।” তিনি অভিযোগ করেন যে, ইউনূস দেশের সার্বভৌমত্ব এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন।

হাসিনা আরও দাবি করেন যে, ইউনূস মাইক্রোফাইনান্সের জন্য একসময় প্রশংসিত হলেও, তিনি এখন চরমপন্থী গোষ্ঠী, এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ মিলিট্যান্টদের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করেছেন। তিনি বলেন, “তিনি সন্ত্রাসীদের সাহায্যে ক্ষমতা দখল করেছেন, এমনকি যারা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ। আমরা বাংলাদেশের মানুষকে তাদের থেকে রক্ষা করেছিলাম। এখন কারাগারগুলো খালি, তারা সবাইকে মুক্ত করে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ মিলিট্যান্টদের দ্বারা শাসিত হচ্ছে।”

আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞা: ‘অবৈধ ও অসাংবিধানিক’
শেখ হাসিনা তার দল আওয়ামী লীগের উপর নিষেধাজ্ঞাকে “অবৈধ এবং অসাংবিধানিক” বলে সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, “যিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন, তিনি কোন অধিকারে সংবিধান স্পর্শ করছেন? তিনি জনগণের ম্যান্ডেট পাননি এবং তার পদ (প্রধান উপদেষ্টা) কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি নেই।” তিনি আরও বলেন যে, ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের শাসনব্যবস্থা অস্থিতিশীল হয়ে পড়েছে এবং তিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন না।

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ঘোষণা করেন যে, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তকে শেখ হাসিনা তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন, এটিকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। তিনি দাবি করেন যে, এই নিষেধাজ্ঞা দেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে আরও অস্থিতিশীল করবে।

রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকা
শেখ হাসিনার এই মন্তব্য এমন এক সময়ে এসেছে, যখন বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমশ বাড়ছে। মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি গত আগস্টে হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, তিনি কেবল হাসিনার সমর্থকদের থেকেই নয়, সেনাবাহিনী এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) কিছু অংশের কাছ থেকেও বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছেন।

সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত সেপ্টেম্বরে বলেছিলেন যে, ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা উচিত। তিনি সম্প্রতি একটি জরুরি বৈঠক ডেকেছিলেন, যেখানে স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার এবং একটি জাতীয় ঐক্য সরকার গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে, তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণার গুজব অস্বীকার করেছেন।

Advertisements

ইউনূস শনিবার সতর্ক করে বলেছেন, যদি সেনাবাহিনী এবং বিরোধী দলগুলোর “অযৌক্তিক দাবি” অব্যাহত থাকে, তবে তিনি “জনগণের সমর্থনে” পদক্ষেপ নেবেন। এই হুমকি তার পদত্যাগের সম্ভাবনাকে আরও জোরালো করেছে।

ছাত্র আন্দোলন এবং নতুন রাজনৈতিক শক্তি
শেখ হাসিনার পতনের পেছনে ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এই আন্দোলনের নেতারা, যারা অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন মুভমেন্ট (এসএডি) নামে পরিচিত, পরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠন করেছে। এই দলটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এনসিপি’র নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ অভিযোগ করেছেন যে, সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে পুনরায় সংযোজনের চেষ্টা করছে, যা তারা ভারতের ইন্ধনে পরিচালিত বলে মনে করেন।

ইউনূসের সরকার এসএডি’র বেশ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করেছে, যা সেনাবাহিনী এবং বিএনপি’র সাথে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। বিএনপি এই ছাত্র প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভা থেকে অপসারণের দাবি জানিয়েছে, যখন এনসিপি দুজন উপদেষ্টার বরখাস্তের দাবি তুলেছে।

ভারতের ভূমিকা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
শেখ হাসিনা ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন এবং বর্তমানে তিনি ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। তিনি ইউনূসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে, তিনি ভারতকে তার বিরুদ্ধে প্রচারণার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করতে দিচ্ছেন, যা দেশের স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করছে।

ইউনূস বলেছেন, ভারতের হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া সহনীয়, তবে তাকে রাজনৈতিক প্রচারণার জন্য ব্যবহার করা উচিত নয়। তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রধান প্রসিকিউটরের সাথে হাসিনার প্রত্যর্পণ নিয়ে আলোচনা করেছেন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্তমানে একটি সংকটময় মোড়ে রয়েছে। শেখ হাসিনার তীব্র সমালোচনা এবং মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের উপর ক্রমবর্ধমান চাপ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়িয়েছে। সেনাবাহিনী, ছাত্র আন্দোলন, এবং বিএনপি’র মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এবং আওয়ামী লীগের নিষিদ্ধকরণ নির্বাচনের পথে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। ইউনূস ২০২৫ সালের শেষ বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাকে সাংবিধানিক এবং নির্বাচনী সংস্কারের জটিল চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে।

বাংলাদেশের জনগণ এখন একটি স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় রয়েছে। তবে, শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মন্তব্য এবং ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের চ্যালেঞ্জগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, এই পথ সহজ হবে না।