পিনাকী ভট্টাচার্য— (Pinaki Bhattacharya) একটি নাম যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে বসবাসরত এই প্রবাসী বাংলাদেশি ব্লগার, লেখক ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নিয়মিত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা ও উসকানিমূলক মন্তব্যের জন্য পরিচিত। সম্প্রতি তার একটি ফেসবুক পোস্ট ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে, যেখানে তিনি জুলাই বিপ্লবের নেতৃত্বদানকারীদের ফাঁসির দাবি জানিয়েছেন এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পুনরাগমনের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এই পোস্টে তিনি ভারত বিরোধিতা, হিন্দু বিরোধী মনোভাব এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন, যা অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ও প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
পিনাকী ভট্টাচার্য কে?
পিনাকী ভট্টাচার্য একজন প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, যিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তবে বর্তমানে তিনি চিকিৎসা পেশায় নেই, বরং ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসা ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বগুড়ার একজন প্রাক্তন শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শ্যামল ভট্টাচার্যের বড় ছেলে। ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং পরবর্তীতে বন্ধুদের সহায়তায় বাংলাদেশ ত্যাগ করে ২০১৯ সালে ফ্রান্সে পৌঁছান। বর্তমানে তিনি প্যারিসে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন এবং সেখানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন। তিনি ইউটিউব, ফেসবুক ও টুইটারে (বর্তমানে এক্স) সক্রিয়, যেখানে তার লক্ষাধিক ফলোয়ার রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং ভারতের প্রভাব নিয়ে নিয়মিত সমালোচনা করেন।
জুলাই আন্দোলন ও পিনাকীর ভূমিকা
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত অসহযোগ আন্দোলন, যা এক দফা আন্দোলন নামেও পরিচিত, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিকে নিয়ে যায়। এই আন্দোলনের সময় পিনাকী ভট্টাচার্য সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে বক্তব্য রেখেছেন এবং সরকারবিরোধী প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ দাবি করেন, তিনি এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মাথা ছিলেন এবং ধানমন্ডিতে শেখ হাসিনার বাড়ি ভাঙচুরে উসকানি দিয়েছেন। তবে এই অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সীমিত, এবং এটি মূলত সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত মতামতের ওপর ভিত্তি করে।
বিতর্কিত ফেসবুক পোস্ট
বৃহস্পতিবার পিনাকী ভট্টাচার্য তার ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে একটি কটাক্ষপূর্ণ মন্তব্য করেন, যা ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তিনি লিখেছেন, “এখন উচিৎ শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রী বানানো… জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলানো… শেখ হাসিনাকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করা।” এই পোস্টে তিনি খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মির্জা ফখরুল এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধেও কটাক্ষ করেছেন। এই মন্তব্যকে অনেকে ব্যঙ্গাত্মক হিসেবে দেখলেও, এটি আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে ক্ষোভ এবং অন্যদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে।
ভারত বিরোধিতা ও হিন্দু বিরোধী অভিযোগ
পিনাকী ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে ভারতের প্রভাব এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলে আসছেন। তিনি ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন এবং ভারতীয় মিডিয়ার বাংলাদেশ-বিষয়ক প্রচারণাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি দাবি করেছেন, ভারতীয় গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার পতনের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার খবর অতিরঞ্জিতভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এই মন্তব্যের কারণে তাকে হিন্দু বিরোধী হিসেবে অভিযোগ করা হয়েছে, যদিও তিনি নিজেকে অসাম্প্রদায়িক বলে দাবি করেন।
আল জাজিরার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের দিন দুজন হিন্দু নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য এবং একজন আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন। এই ঘটনাগুলোকে হিন্দু বিরোধী হামলা হিসেবে প্রচার করা হলেও, প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে এটি মূলত আওয়ামী লীগের প্রতি জনরোষের ফলাফল, ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়। পিনাকী এই ধরনের প্রতিবেদনের সমর্থনে কথা বলেছেন, যা তাকে আরও বিতর্কের মুখে ফেলেছে।
পিনাকীর পরিচয় নিয়ে বিতর্ক
পিনাকী ভট্টাচার্যের নাম অমুসলিম শোনালেও, কেউ কেউ তাকে মুসলিম বলে দাবি করেছেন। তিনি নিজেকে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সদস্য হিসেবে পরিচয় দেন এবং বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে স্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি, এবং এটি সামাজিক মাধ্যমে বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে।
জনমত ও প্রতিক্রিয়া
পিনাকীর সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্ট সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়েছে। এক্স-এ কেউ তাকে জুলাই বিপ্লবের “মাষ্টার মাইন্ড” হিসেবে অভিহিত করেছেন, আবার কেউ তাকে স্বৈরাচারের সমর্থক বলে সমালোচনা করেছেন। তার সমালোচকরা বলছেন, তার মন্তব্যগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। অন্যদিকে, তার সমর্থকরা তাকে একজন সাহসী অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে দেখেন, যিনি দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলেন।
পিনাকী ভট্টাচার্যের সাম্প্রতিক মন্তব্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তার ভারত বিরোধিতা, আওয়ামী লীগের সমালোচনা এবং জুলাই আন্দোলনের নেতাদের ফাঁসির দাবি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। তিনি যদিও দাবি করেন তার লক্ষ্য বাংলাদেশের উন্নতি, তার উসকানিমূলক মন্তব্য অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও সামাজিক সম্প্রীতির জন্য এই ধরনের বক্তব্যের প্রভাব কী হবে, তা সময়ই বলবে।