ঢাকা: দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে আবারও উদ্বেগের মেঘ। পাকিস্তানের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে অহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর নিপীড়ন, হামলা ও চরমপন্থী উসকানির পেছনে পাকিস্তানি আইএসআই–এর ভূমিকার অভিযোগ বহুদিনের। এবার সেই অভিযোগের ছায়া নেমে এল বাংলাদেশেও। সাম্প্রতিক ধর্মীয় সম্মেলনকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে আবারও সক্রিয় হচ্ছে অ্যান্টি-আহমদিয়া বর্ণবাদী গোষ্ঠীগুলো এমনটাই দাবি করছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের একাংশ।
১৫ নভেম্বর ঢাকার কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত হয় “ইন্টারন্যাশনাল ফিদা-ই মিল্লাত কনফারেন্স ২০২৫”। ইসলামপন্থী বিভিন্ন সংগঠনের এই আন্তর্জাতিক সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, তুরস্ক, ইউরোপ ও ইংল্যান্ডের নেতারা। কিন্তু এই পুরো আয়োজনকে কেন্দ্র করে প্রশ্ন উঠছে কার প্রভাবে, কার অর্থায়নে, এবং কী উদ্দেশ্যে হঠাৎ করে বাংলাদেশে এত বড় ধর্মীয় সম্মেলন?
৩ বল খেলেই মাঠ ছাড়েন গিল, আর খেলতে পারবেন? জানাল বোর্ড
মূল উদ্বেগের কারণ সম্মেলনে উপস্থিতদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা ফজলুর রহমান, প্রেসিডেন্ট, জামিয়াত-ই উলামা-ই ইসলাম পাকিস্তান। পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অহমদিয়াদের বিরুদ্ধে চরম ঘৃণা ও সহিংসতা উসকে দেওয়ার অভিযোগ বহুবার উঠেছে তাঁর সংগঠনের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যালঘু নিপীড়নে আইএসআই যেভাবে ধর্মীয় সংগঠনগুলোকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, বাংলাদেশে তাঁর প্রতিফলন দেখা গেলে তা উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশে এই সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন আল্লামা মুছিবুল্লাহ বাবুনগরী, আমির, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ মাওলানা খালিদ আহমেদ কোরাইশী, ডিরেক্টর জেনারেল, হাটহাজারী মাদ্রাসা, মাওলানা ড. এ.এফ.এম খালিদ হাসেন, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা, অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন মাওলানা আব্দুল হামিদ, আমির, খতমে নবুওয়াত প্রিজারভেশন কমিটি।
এছাড়াও তুরস্ক থেকে মুফতি জুহাইব ইকবাল, নেপাল থেকে মাওলানা খালেদ সিদ্দিকী, বাংলাদেশ থেকে মাওলানা উবাইদুল্লাহ ফারুক, , পাকিস্তান থেকে মাওলানা সাইয়েদ ফয়সাল নদিম, ইংল্যান্ড থেকে ড. মাওলানা সুহাইব আহমদ, ইউরোপ থেকে মুফতি শাহ সাদর উদ্দিন,
এই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ভারতের মাওলানা সাইয়েদ মাহমুদ আস‘আদ মাদানি, প্রেসিডেন্ট, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ। তাঁর উপস্থিতিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক আরও বেড়ে গেছে, কারণ ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান—তিন দেশের একাধিক ইসলামী সংগঠনের এই সম্মিলনকে অনেকেই আঞ্চলিক রাজনীতির নতুন ‘ধর্মীয় ব্লক’ হিসেবে দেখছেন।
বাংলাদেশে ২০০৫ সালের পর থেকে সংগঠিত অ্যান্টি-আহমদিয়া হামলা কার্যত বন্ধ হয়েছিল। বিভিন্ন সরকারের কঠোর অবস্থানের কারণে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার হারও কমে এসেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করে বৈঠক, মহড়া ও প্রচারে অ্যান্টি-আহমদিয়া বক্তব্যের পুনরুত্থান দেখে নিরাপত্তা বাহিনীর একাংশ আশঙ্কা করছেন—বাহ্যিক শক্তির প্রভাব আবারও বাংলাদেশে প্রবেশ করছে কিনা।
একাধিক আঞ্চলিক বিশেষজ্ঞ বলছেন, পাকিস্তানে যেমন অহমদিয়াদের সাংবিধানিকভাবে অমুসলিম ঘোষণা করে তাদের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তেমনি চরমপন্থী সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করে সেখানে সামাজিক বিভাজনকে বাড়ানো হয়েছে। এখন সেই একই মডেল যদি বাংলাদেশে প্রয়োগের চেষ্টা হয়, তবে তা দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় সম্প্রীতির জন্য ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে পারে।
স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশে যেসব ইসলামপন্থী সংগঠন দীর্ঘদিন নিষ্ক্রিয় ছিল, এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের পর তাদের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। ফলে নিরাপত্তা মহলে প্রশ্ন—এই পুনরুত্থান কি কাকতালীয়, নাকি এর পেছনে রয়েছে সুপরিকল্পিত বৈদেশিক নকশা?
বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সংখ্যালঘু নিরাপত্তার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বর্তমানে অ্যান্টি-আহমদিয়া ইস্যু নিয়ে যেভাবে উত্তেজনা বাড়ছে, তাতে প্রশাসনকে আরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ একবার যদি উগ্র গোষ্ঠীগুলো শক্তি ফিরে পায়, দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশ কি পাকিস্তানের মতো ধর্মীয় উগ্রবাদের পুনরুত্থানের মুখোমুখি হতে চলেছে? প্রশ্নটা এখন দেশের নিরাপত্তা মহল থেকে সাধারণ মানুষের ঘরেও পৌঁছে গেছে।


