শেখ হাসিনার হুকুমে ‘নিষিদ্ধ’ জামাত, কট্টর ইসলামি দলটির জন্ম ভারতে

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: পরাধীন ভারতে জন্ম নিয়েছিল দুটি ধর্মভিত্তিক  সংগঠন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (১৯২৫) এবং জামাত ইসলামি (১৯৪১)। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দুটি সংগঠনেরই ভূমিকা…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: পরাধীন ভারতে জন্ম নিয়েছিল দুটি ধর্মভিত্তিক  সংগঠন হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (১৯২৫) এবং জামাত ইসলামি (১৯৪১)। স্বাধীনতা সংগ্রামে এই দুটি সংগঠনেরই ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। স্বাধীনতার পর ভারতে উগ্র ‘হিন্দু রাজনীতির ধারক’ সংঘ পরিবার নিষিদ্ধ হয়েছিল। আর কট্টর  ইসলামি সংগঠন জামাতকে কালো তালিকায় রেখে নিষিদ্ধ করেছিল পাকিস্তান! আরও পরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (Bangladesh) বাংলাদেশে বারবার জামাত ঢুকেছে নিষিদ্ধ তালিকায়।

বাংলাদেশে (Bangladesh) দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হল জামাত ইসলামি। এই দলটির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত বিক্ষোভ ছড়িয়ে অভ্যুত্থানের অভিযোগ এনেছে শেখ হাসিনার (Sheikh Hasina) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) সরকারি নোটিশ জারির পর থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগুরু বাংলাদেশে প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারবে না ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’।

   

সরকারি নোটিশ উদ্ধৃত করে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা জানাচ্ছে জামাত ইসলামির বিরুদ্ধে “জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি” অভিযোগ আনা হয়। সংগঠনটিকে বাংলাদেশের সন্ত্রাস দমন আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। জামাত ইসলামির সব শাখা সংগঠন নিষিদ্ধ তালিকাভুক্ত হয়েছে।

গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের মামলায় একাধিক জামাত ইসলামি নেতার ফাঁসির সাজা হয়েছে বাংলাদেশে। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকেই বন্দি, কেউ আছেন আত্মগোপনে। মিশরের চরমপন্থী ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’ আদর্শ নিয়ে চলে জামাত। দু’দশক আগে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি জোট সরকারের (২০০১) শরিক হিসেবে বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল জামাত ইসলামি।

বাংলাদেশে জামাত দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ:
১৯৭১ সালে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লড়াই ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বিরোধিতা করেছিল জামাত ইসলামি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে প্রথমবার জামাত ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহারের’ কারণে। তখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘নিষিদ্ধ’ জামাত নেতারা পাকিস্তানে নির্বাসনে চলে যান।  অর্ধ শতক পার করে এবার (২০২৪) মুজিবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাংলাদেশে দ্বিতীয়বার নিষিদ্ধ হয়ে গেল নাশকতা ছড়ানোয় অভিযুক্ত জামাত ইসলামি।

Bangladesh

গোপন ডেরা থেকে ‘নিষিদ্ধ’ জামাতের প্রতিক্রিয়া:
জামাত ইসলামির বাংলাদেশ শাখার আমির (প্রধান) ড. শরিফুর রহমান প্রকাশ্যে নেই। তাঁর নামে দলটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “একটি রাজনৈতিক দল বা জোট অন্য একটি রাজনৈতিক দলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের আইন ও সংবিংধান কাউকে এ এখতিয়ার দেয়নি। কোনো দল বা জোট অন্য কোনো দলকে নিষিদ্ধ করার ধারা চালু হলে এক দল অন্য দলকে নিষিদ্ধ করতে থাকবে।  তখন রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না।”

জামাত ইসলামির জন্ম ‘হিন্দু গরিষ্ঠ’ ভারতে:
ভারত মূলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী গরিষ্ঠ বলে চিহ্নিত।  পরাধীন ভারতে যেমন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস জন্ম নিয়েছিল, তেমনই ১৯৪১ সালে হায়দরাবাদের ইসলামি স্কলার আবুল আলা মওদুদি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামাত ইসলামি। ভারত ভাগের পর এই সংগঠনটি জামাত ইসলামি হিন্দ ও জামাত ইসলামি পাকিস্তান দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আরও একটি শাখা গঠিত হয় আফগানিস্তানে।

মুসলিম গরিষ্ঠ পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল জামাত:
ভারতে নিষিদ্ধ নয় জামাত ইসলামি। তবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগুরু দেশ পাকিস্তানে দুবার নিষিদ্ধ হয়েছিল জামাত। প্রথমবার ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনা শাসক জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে সামরিক আইন জারির পর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জামাত ইসলামি নিষিদ্ধ হয়েছিল। দ্বিতীয়বার পাক সরকার জামাতকে নিষিদ্ধ করে ১৯৬৪ সালে।

পদ্মাপারের রাজনীতিতে জামাত :
১৯৭১ সালে  পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ। ১৯৭৫ সালে সেনা অভ্যুত্থান হয়েছিল বাংলাদেশে। সেই অভ্যুত্থানে বিদ্রোহী সেনা অফিসাররা বাংলাদেশের ‘জাতির পিতা’ শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের আরও সদস্যদের খুন করে। অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেনাকর্তা জিয়াউর রহমান। তাঁর শাসনকালে জামাত ইসলামির নিষেধাজ্ঞা বাতিল হয়েছিল।

সেনা শাসক জিয়াউর রহমানকে আরও একটি সেনা অভ্যুত্থানে ১৯৮১ সালে খুন করেন কয়েকজন বিদ্রোহী সেনাকর্তা। এরপর বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসেন আরও এক সেনাকর্তা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

জিয়াউর রহমান ও এরশাদের সময়ে বাংলাদেশে সেনাশাসন চলছিল। এই সময়েই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন জামাত ইসলামির নেতারা।

ক্ষমতায় থাকাকালীন জিয়াউর রহমান তৈরি করেছিলেন বিএনপি দল। আর এরশাদ গঠন করেন জাতীয় পার্টি। এরশাদের সেনা শাসনের বিরোধিতা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে একজোট  হয়েছিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। সেই আন্দোলনে অংশ নেয় জামাত ইসলামি। ১৯৯০ দশকে সেনাশাসক এরশাদের পতন হয়। এরপর জামাত ইসলামি ও বিএনপি কাছাকাছি আসে। তাদের প্রতিপক্ষ হয় আওয়ামী লীগ।

বাংলাদেশের সুশীল সমাজ বনাম জামাত:
জামাত নিষিদ্ধের দাবি নব্বইয়ের দশকেই তীব্র হয়েছিল বাংলাদেশে। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ নামে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লিপিকার জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে জামাত ইসলামি বিরোধী আন্দোলন। ২০১৩ সালে গণজাগরণ মঞ্চ থেকে জামাতসহ বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী বিরোধী আন্দোলন আরও জোরালো হয়। আইনি প্রক্রিয়ায় সেই বছর জামাত ইসলামির নিবন্ধন বাতিল হয়। দলটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা হারায়। তবে নির্দল হিসেবে তারা ভোটে লড়ছিল। জামাত ইসলামি ও তাদের শাখা সংগঠন ছাত্র শিবির, বিএনপি একযোগে বারবার সরকার বিরোধী রক্তাক্ত আন্দোলনে অভিযুক্ত।