দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত মানচিত্রে নতুন মোড়। ঢাকায় নিজেদের হাইকমিশনের ভেতর বিশেষ একটি আইএসআই (ISI) সেল গঠন করেছে পাকিস্তান, এমনটাই জানিয়েছে ভারতের শীর্ষ গোয়েন্দা সূত্র। এই পদক্ষেপকে ইসলামাবাদ ও ঢাকার মধ্যে দ্রুত গভীরতর হতে থাকা গোয়েন্দা ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার স্পষ্ট ইঙ্গিত বলেই মনে করা হচ্ছে।
পাক জেনারেলের সঙ্গ বৈঠকের পরই অগ্রগতি
সূত্র জানাচ্ছে, এই সিদ্ধান্তের সূত্রপাত পাকিস্তানের চেয়ারম্যান অফ জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফ কমিটি জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সাম্প্রতিক ঢাকা সফর থেকেই। চার দিনের সেই সফরে তিনি সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মহম্মদ ইউনূস, সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান ও বিমানপ্রধানের সঙ্গে।
জেনারেল মির্জার নেতৃত্বে ছিল আট সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল—যার মধ্যে ছিলেন আইএসআই-এর এক মেজর জেনারেল, পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর প্রতিনিধিরাও। ঢাকায় তারা বৈঠক করেন বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (NSI) এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (DGFI)-এর শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে।
যৌথ গোয়েন্দা কাঠামোর পথে দুই দেশ ISI Cell in Dhaka
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, একটি যৌথ গোয়েন্দা সহযোগিতা ও তথ্য-বিনিময় কাঠামো গঠনে সম্মত হয়েছে দুই দেশ, যার মূল লক্ষ্য বঙ্গোপসাগর অঞ্চলের নজরদারি এবং ভারতের পূর্ব সীমান্তবর্তী আকাশপথে গোয়েন্দা তৎপরতা জোরদার করা।
নতুন এই ব্যবস্থায় ঢাকা সরকার পাকিস্তানকে অনুমতি দিয়েছে হাইকমিশনে গোয়েন্দা অফিসার নিয়োগের জন্য। প্রথম পর্যায়ে সেখানে একজন ব্রিগেডিয়ার, দুই কর্নেল, চার মেজর এবং বিমান ও নৌবাহিনীর অফিসারসহ সহায়ক কর্মী নিযুক্ত হবেন বলে জানা গেছে।
প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় গতি আনছে ইসলামাবাদ
প্রতিদানে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বৃদ্ধি করছে। প্রস্তাব এসেছে যৌথ সামরিক প্রশিক্ষণ, নৌ ও বিমান মহড়া এবং ইনফ্যান্ট্রি ও আর্টিলারি সিস্টেম সরবরাহের। ঢাকা আগ্রহ দেখিয়েছে পাকিস্তানের JF-17 থান্ডার যুদ্ধবিমান ও ফাতাহ সিরিজের রকেট সিস্টেম কেনার বিষয়ে।
খুব শিগগিরই এক উচ্চপর্যায়ের বাংলাদেশি সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তান সফরে যাবে, যেখানে কয়েকটি MoU ও প্রতিরক্ষা চুক্তি চূড়ান্ত হতে পারে বলে সূত্রের খবর।
হাসিনা-পরবর্তী যুগে নয়া বাস্তবতা
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে দ্রুত বদলেছে ঢাকা-ইসলামাবাদ সম্পর্কের সুর। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী প্রশাসন গঠনের পর পাকিস্তানই প্রথম সমর্থন জানায় নতুন সরকারকে, উল্লেখ করে “বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে সংহতির” বার্তা।
এরপর থেকেই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উষ্ণতর হয়েছে, কূটনৈতিক ভিসা-মুক্ত ভ্রমণ, বাণিজ্য সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সমঝোতা, সমুদ্র ও আকাশপথ সংযোগ, সব ক্ষেত্রেই চুক্তি সই হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। গত এক বছরে অন্তত তিন দফা বৈঠক হয়েছে অধ্যাপক ইউনুসের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ও উপপ্রধানমন্ত্রী ইশাক দার-এর।
দুই দেশের সেনা নেতৃত্বের মধ্যেও এখন বাড়ছে যোগাযোগ। বাংলাদেশের জেনারেলরা সফর করেছেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স (GHQ), অপরদিকে ঢাকায় পাকিস্তানি সামরিক প্রতিনিধিদের দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় মর্যাদার অভ্যর্থনা।
কৌশলগত পুনর্গঠনের সংকেত
সবশেষে ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনের মধ্যে আইএসআই সেল প্রতিষ্ঠা, দুই দেশের নবগঠিত সম্পর্কের সবচেয়ে সুস্পষ্ট ও প্রতীকী পদক্ষেপ বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
বিশ্লেষকদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্যে এটি নতুন মাত্রা যোগ করবে, বিশেষত বঙ্গোপসাগর ঘিরে ভারত, চীন, ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রেক্ষাপটে।

