বাংলাদেশের (Bangladesh) অন্তর্বর্তী সরকার প্রধান মুহাম্মদ ইউনুস রবিবার একটি জাতীয় ভাষণে ঘোষণা করেছেন যে, শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে প্রত্যর্পণের জন্য বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন করবে। আগস্ট মাসে দেশব্যাপী গণতান্ত্রিক প্রতিবাদের কারণে হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি ভারতে চলে যান। ইউনুস তার ভাষণে উল্লেখ করেন যে, এই ১০০ দিনের মাইলফলক উপলক্ষে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত আবেদনটি সরকারীভাবে উপস্থাপন করা হবে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা
গত আগস্টে বাংলাদেশে ছাত্রদের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন শুরু হয়, যা একদিকে সরকারি চাকরির কোটা প্রথা নিয়ে বিতর্কের কারণে উত্তাল হয়ে ওঠে, অন্যদিকে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদের জন্ম দেয়। আন্দোলনটি দেশজুড়ে সহিংসতায় রূপান্তরিত হয়ে হাসিনার সরকারকে পতন ঘটায়। হাজার হাজার আহত ও ১,৫০০ জনেরও বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই পরিস্থিতিতে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের শীর্ষ নেত্রী হিসেবে ভারত পালিয়ে যান। মুহাম্মদ ইউনুস তার ভাষণে বলেন, “প্রত্যেকটি প্রাণের ক্ষতি কষ্টজনক, এবং আমরা নিশ্চিত করবো যে তাদের জন্য ন্যায়বিচার হবে। শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে প্রত্যর্পণের জন্য আমরা আনুষ্ঠানিক আবেদন জানাব।”
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ সম্পর্কিত বক্তব্য
যদিও ইউনুস সরকারের প্রশাসন সহিংসতার শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ সম্পর্কে কিছুটা সমালোচনা করেছেন, তবে তিনি বলেন, এসব ঘটনা অতিরঞ্জিত হয়েছে এবং এসব হামলা মূলত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য চালানো হয়েছে। ইউনুস বলেন, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বড় ধরনের আক্রমণ হয়নি।
তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই ধরনের সহিংসতা ঘটানো হয়েছে এবং এর অধিকাংশই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। তিনি আরও বলেন, “আমাদের প্রশাসন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ রয়েছে, এমনকি যারা হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” ইউনুস এর আগে ঘোষণা করেছিলেন যে, হাসিনার শাসনামলে ১,৬০০টি অপহরণের ঘটনা ঘটেছে, এবং সামগ্রিক সংখ্যা ৩,৫০০-এরও বেশি হতে পারে।
নির্বাচনী সংস্কার এবং কমিশন গঠনের ঘোষণা
মুহাম্মদ ইউনুস তার ভাষণে আরও উল্লেখ করেন যে, সরকারের লক্ষ্য হলো এক নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন এবং নির্বাচন ব্যবস্থায় সংস্কার আনা। তিনি আশ্বস্ত করেন যে, আগামী সাধারণ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে এবং জনগণের কাছে এর জন্য একটি রোডম্যাপ শীঘ্রই উপস্থাপন করা হবে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি, যে দলের নেতৃত্বে আছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, তারা নির্বাচন সংক্রান্ত স্পষ্ট রোডম্যাপ চেয়ে আসছে।
ইউনুস বলেন, “আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, ভবিষ্যত নির্বাচনে জনগণ তাদের ভোটাধিকার সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে। নির্বাচন কমিশন গঠন এবং ব্যবস্থাপনাতে আমরা সুনির্দিষ্ট সংস্কার আনব যাতে সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।”
শেখ হাসিনার শাসনামল এবং নির্দলীয় সরকারের ভূমিকা
ইউনুস বলেন, হাসিনার শাসনামল ছিল “একদলীয়” এবং তিনি তার বিরোধীদের প্রতি অত্যাচার চালিয়েছেন। ইউনুস আরও বলেন, ছাত্রদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং প্রতিবাদীদের দমন করার জন্য সরকার অমানবিক শক্তি প্রয়োগ করেছিল। তিনি ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু সরকারের মাধ্যমে দেশের উন্নতির পথে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে, তারা আগামী দিনে একটি কল্যাণকর, মুক্ত ও সুষ্ঠু সরকার পাবে এবং সকল প্রকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য শাস্তি প্রদান করা হবে।
এছাড়া ইউনুস তার ভাষণে আরও বলেছেন, তাদের সরকার পরিকল্পনা করছে যাতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবর্তন আনতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা যায়, যার মাধ্যমে দেশ ভবিষ্যতে আরও শান্তিপূর্ণ ও সুশাসিত হবে।
সামাজিক ও রাজনৈতিক শান্তির প্রতিশ্রুতি
ইউনুস তার সরকারের কর্তৃত্বাধীন সময়ে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে আনার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন, এবং মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জনগণের প্রতি তার বিশ্বাস তুলে ধরে বলেন, “আমরা আমাদের শাসনকালে প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা, স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবো। অতীতের ভুলগুলো শুধরে, আমরা বাংলাদেশকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাব।”
বাংলাদেশের আগামী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে সবার মধ্যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে, তবে শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা অব্যাহত থাকবে।
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষণা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমালোচনার সম্মুখীন হলেও, মুহাম্মদ ইউনুস দেশের
উন্নতি ও শান্তির জন্য আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার এই সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হিসেবে সামনে রয়েছে।