ঢাকা, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের (Bangladesh Interim Government) তথ্য উপদেষ্টা এবং ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা নাহিদ ইসলাম মঙ্গলবার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। এই পদক্ষেপ এসেছে জুলাই বিদ্রোহের কর্মীদের দ্বারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রাক্কালে। নাহিদ, যিনি গত বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য জুলাইয়ের গণ-আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন, বলেছেন যে তিনি রাস্তায় থেকে গণ-অভ্যুত্থানকে আরও শক্তিশালী করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মুখ্য উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ বলেন, “দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান অত্যন্ত জরুরি। আমি উপদেষ্টা পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেছি যাতে রাস্তায় থেকে গণ-অভ্যুত্থানকে আরও সুসংহত করতে পারি।” তিনি আরও জানান, সরকারে থাকার চেয়ে রাস্তায় জনগণের পাশে থাকা তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।
নাহিদ ইসলাম তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন, যা কার্যত দুটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সমতুল্য। তিনি বলেন, “আমি জনগণের গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার জন্য কাজ করতে চাই, এবং তাই আমি উপদেষ্টার পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি।”
জুলাই বিদ্রোহ ও অন্তর্বর্তী সরকারের পটভূমি
গত বছর ৫ আগস্ট ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর নেতৃত্বে একটি গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার দীর্ঘদিনের শাসনের অবসান ঘটে। এই আন্দোলন প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও পরে তা সরকারবিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের তিন দিন পর, ৮ আগস্ট, নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নাহিদ ইসলাম এই আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধির একজন হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দিয়েছিলেন।
তবে, এই পদত্যাগের সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সম্ভাবনা জড়িয়ে গেছে। চলতি মাসের শুরুতে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ এবং এর সহযোগী সংগঠন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ ঘোষণা করেছিল যে তারা শুক্রবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে। যদিও দলের নাম এখনও প্রকাশ করা হয়নি, সূত্র মতে, নাহিদ ইসলাম এই দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে যোগ দিতে পারেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
নাহিদের এই পদত্যাগের পেছনে রাজনৈতিক পরিস্থিতিও একটি বড় ভূমিকা পালন করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী সমালোচনা করে বলেছে যে, সরকারে থাকা প্রতিনিধিরা যদি নতুন দল গঠন করে, তবে তা ক্ষমতার অপব্যবহার হবে। বিএনপি মনে করে যে, এই ধরনের পদক্ষেপ অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলতে পারে।
অন্যদিকে, শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ এই বিষয়ে প্রায় নীরব রয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো অভিযোগে দলটির বেশিরভাগ নেতা এখন কারাগারে বা পলাতক। জাতিসংঘের একটি তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী সরকার বিক্ষোভকারীদের নির্মমভাবে দমন করতে চেয়েছিল। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৫ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে প্রায় ১৪০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, এবং হাসিনার পতনের পরও প্রতিশোধমূলক হিংসা অব্যাহত ছিল।
আন্দোলনের সঙ্গীদের ভূমিকা
নাহিদের দুই সহযোগী, মাহফুজ আলম এবং আসিফ মাহমুদ, এখনও উপদেষ্টা হিসেবে সরকারে রয়েছেন। নাহিদ বলেন, “সরকারে থাকা ছাত্র উপদেষ্টারা ন্যায়বিচার এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে সক্রিয় থাকবেন, যে প্রতিশ্রুতি সরকার দিয়েছে।” তিনি এও ইঙ্গিত দেন যে, তার পদত্যাগ সত্ত্বেও আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনে তার সহযোদ্ধারা কাজ করে যাবেন।
মুখ্য উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস আগেই বলেছিলেন যে তিনি ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে একটি দল গঠনের বিষয়ে সমর্থন করেন, কারণ এই তরুণরা দেশের জন্য রক্ত দিতে প্রস্তুত ছিল। তিনি এই আন্দোলনকে একটি নতুন গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার প্রতীক হিসেবে দেখেন।
নাহিদের পথ ও ভবিষ্যৎ
নাহিদ ইসলামের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে তার পড়াশোনার পাশাপাশি আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয় পরিচিতি লাভ করেছেন। গত বছর জুলাইয়ে তাকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তবুও তিনি আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছেন এবং শেষ পর্যন্ত হাসিনার পতনের পথ প্রশস্ত করেছেন।
নতুন দল গঠনের ঘোষণা আগামী শুক্রবার ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে একটি বৃহৎ সমাবেশের মাধ্যমে দেওয়া হবে বলে জানা গেছে। এই দলটি ছাত্র ও নাগরিকদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গঠিত হবে এবং গণতান্ত্রিক পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে। নাহিদের নেতৃত্বে এই দল কীভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভূ-প্রকৃতি পরিবর্তন করে, তা দেখার জন্য দেশবাসী অপেক্ষায় রয়েছে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও প্রশ্ন
নাহিদের পদত্যাগ এবং নতুন দল গঠনের উদ্যোগ এমন এক সময়ে এসেছে যখন অন্তর্বর্তী সরকারের উপর চাপ বাড়ছে। হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনায় ইউনূস সরকার সমালোচনার মুখে পড়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থকরা ইউনূসের পদত্যাগ দাবি করেছে, তাকে “সংখ্যালঘু হত্যাকারী” হিসেবে অভিহিত করে বিক্ষোভ করেছে। এই পরিস্থিতিতে নাহিদের রাস্তায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলবে, তা সময়ই বলবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রশক্তি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান, তরুণরা বারবার পরিবর্তনের মুখ হয়ে উঠেছে। নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে নতুন এই দল কি সেই ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, নাকি নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে? দেশের জনগণ এখন এই প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায়।