বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর সোমবার রাতজুড়ে দেশ এক অস্থির, অগ্নিগর্ভ পরিবেশের মধ্যে দিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এই ঐতিহাসিক ও বিতর্কিত রায় কার্যত পাঁচটি জেলায় সহিংসতার আগুন জ্বালিয়ে দেয়—বিক্ষোভ, অগ্নিসংযোগ, সড়ক অবরোধ ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ঢাকা থেকে জেলা শহর। দেশের রাজনৈতিক হৃদয়-স্থল ধানমণ্ডি ৩২ রাতারাতি পরিণত হয় রণক্ষেত্রে; আহত হন নিরাপত্তা বাহিনী-সহ অন্তত পঞ্চাশ জন। শুধু রাজধানীই নয়, উত্তেজনার ঢেউ পৌঁছে যায় কিশোরগঞ্জেও, যেখানে হামলার মুখে পড়েন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এই রায়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ এখন এক গভীর রাজনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে।
মৃত্যুদণ্ডের রায়কে কেন্দ্র করে সহিংস রাত
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) শেখ হাসিনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়। একই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং প্রাক্তন পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। যদিও মামুনকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হয়, তবু আদালত তাঁর বিরুদ্ধে “সৌম্য শাস্তি”র ইঙ্গিত দেয়।
এই রায় ঘোষণার পরই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অন্তত পাঁচটি জেলায় প্রতিবাদ কার্যোত্তেজিত হয়ে ওঠে জনতা। বিভিন্ন স্থানে গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর হয় দোকানপাট, বিক্ষোভকারীরা অবরোধ গড়ে তোলে প্রধান প্রধান সড়কে।
ধানমণ্ডি ৩২, রাজনৈতিক স্মৃতির পথে রক্তাক্ত সংঘর্ষ Bangladesh Hasina Verdict Violence
সবচেয়ে তীব্র উত্তেজনা দেখা দেয় ঢাকার ধানমণ্ডি ৩২-এ। ঐতিহাসিকভাবেই রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এই অঞ্চলে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন। এখানেই সোমবার সন্ধ্যার পর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি মুহূর্তেই রণক্ষেত্রের রূপ নেয়।
পুলিশ জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। ধানমণ্ডি ৩২ এলাকায় অন্তত ৫০ জন আহত হন, যাদের মধ্যে কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মীও রয়েছেন বলে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে উল্লেখ করা হয়েছে।
দেশজুড়ে অগ্নিসংযোগ ও বোমা হামলার ঢেউ
গত এক সপ্তাহ ধরেই বাংলাদেশজুড়ে অস্থিরতা বাড়ছিল। বিভিন্ন জেলায় মোট ৫০টিরও বেশি অগ্নিসংযোগ ও ককটেল/ক্রুড বোমা হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই সব ঘটনায় অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে রায় ঘোষণার পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে; অসংখ্য গাড়ি ও মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
কিশোরগঞ্জে হামলা: নিশানায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির বাড়ি
সহিংসতার আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে কিশোরগঞ্জে। সেখানকার স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সোমবার রাতেই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়িতে হামলা চালায় ২০–৩০ জনের একটি দল। প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে, হাসিনার রায় ঘোষণার পর বেরোনো এক মিছিল ওই পথ ধরে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই এই হামলা হয়। বাড়িতে ভাঙচুর হয়, নিরাপত্তারক্ষীরা আহত হন।
ট্রাইব্যুনালের ভূমিকা ও মামলার প্রেক্ষাপট
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলির মধ্যে ছিল ২০২৪ সালের জুলাই মাসের আন্দোলন-সংক্রান্ত মানবতাবিরোধী অপরাধ। ট্রাইব্যুনাল দাবি করেছে, ওই সময় সরকারি নির্দেশে ব্যাপক দমনপীড়ন চালানো হয়, যার দায় ব্যক্তিগত নেতৃত্ব হিসেবে হাসিনাকেই বহন করতে হবে।
এই ট্রাইব্যুনাল মূলত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার জন্য গঠিত হলেও, বর্তমান মামলাটি আধুনিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে—এমনটাই বিশ্লেষকদের মত।
রাজনৈতিকভাবে চরম উত্তেজনার ইঙ্গিত
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখে দেশজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা বাহিনী। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন, দূতাবাস, আদালত চত্বর ও রাজনৈতিক স্থাপনা ঘিরে বর্ধিত নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে রায়কে “রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শাসন” বলে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, “আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করেছে, রায় আইনি প্রমাণের ভিত্তিতে।”
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আগামী জাতীয় নির্বাচন এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ওপর এই রায়ের প্রভাব অত্যন্ত গভীর বলে বিশ্লেষকদের মত।
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহ এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে উত্তেজনার পাশাপাশি রয়েছে অনিশ্চয়তা, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ এবং ভবিষ্যতের প্রতি গভীর সংশয়। দেশজুড়ে পরিস্থিতি এখনও অগ্নিগর্ভ; আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতায়। রায়ের রাজনৈতিক অভিঘাত আগামী কয়েকদিনে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
