ঢাকার গুলশানে জঙ্গি হামলার কালরাত পেরিয়ে তদন্ত কোন দিকে? বিশেষ নজরে বর্ধমান

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ঈদের ঠিক আগে রমজান চলছিল। সন্ধ্যা নেমেছে। মহানগরী ঢাকার রাজপথে জনস্রোত। পোশাক বিপনীগুলিতে ভিড়। ফুটপাতের খাবারের দোকানগুলিতে গরম নেহারি (মাংসের সুরুয়া) ও বড়বড়…

প্রসেনজিৎ চৌধুরী: ঈদের ঠিক আগে রমজান চলছিল। সন্ধ্যা নেমেছে। মহানগরী ঢাকার রাজপথে জনস্রোত। পোশাক বিপনীগুলিতে ভিড়। ফুটপাতের খাবারের দোকানগুলিতে গরম নেহারি (মাংসের সুরুয়া) ও বড়বড় হোটেল রেস্তোরাঁয় চলছে রোজা ভাঙার পর ইফতারি খাওয়া। বুড়িগঙ্গার ধারে সদরঘাটে দুলতে থাকা লঞ্চগুলি দূর্রবর্তী গন্তব্যের জন্য ভেঁপু বাজাচ্ছে। সেই রাতে ”#Dhaka Cafe Attack” হ্যাসট্যাগ হয়ে গেছিল বিশ্বের অন্যতম সার্চ ওয়ার্ড।

১৯৭১ সাল থেকে বেশকয়েকটি রক্তাক্ত ‘কালরাত্রি’ এসেছে বাংলাদেশে। তার একটি হল ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত। এই রাতে ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসের ঠিকানা সম্বলিত অভিজাত-কূটনৈতিক অঞ্চল গুলশানের হোলি আর্টিজান ক্যাফেতে জঙ্গি হামলা হল। ‘ইসলাম রক্ষা’র নামে ইফতার করা গ্রাহকদের কুপিয়ে কুপিয়ে খুনের ভয়াবহতায় বিশ্ব শিহরিত হয়ে গেল।

   

সশস্ত্র হামলাকারীদের সঙ্গে নিজেদের সাংগঠনিক পতাকার ছবি দিয়ে গুলশান হামলার দায় নিয়েছিল ইসলামিক স্টেট জঙ্গি সংগঠন। তবে বাংলাদেশ সরকারের দাবি, এই হামলায় জড়িত নব্য জেএমবি সংগঠন। হামলায় বাংলাদেশি, ইটালীয়, জাপানি, ভারতীয় মিলে মোট ২২ জন নাগরিকের মৃত্যু হয়। হামলাকারীদের রুখতে গিয়ে ২ পুলিশ অফিসারের মৃত্যু হয়। পরে অপারেশন থান্ডারবোল্ড কমান্ডো অভিযানে হামলাকারী ৫ জঙ্গিকে খতম করে বাংলাদেশ সরকার।

আনসার আল ইসলাম জঙ্গি সংগঠনের মাথা লুকিয়ে ভারতে, ইঙ্গিত দিল বাংলাদেশ

গুলশান হামলার পর জঙ্গিদের লক্ষ্য কী?

(১) নতুন হামলার আগে প্রচার: গুলশান জঙ্গি হামলার বর্ষপূর্তিতে বাংলাদেশ জুড়ে নিরাপত্তার কড়াকড়ি। বাংলাদেশ জঙ্গি দমন শাখা (কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বা সিটিটিসি) তদন্তে উঠে এসেছে, সেই হামলার পর একাধিক অভিযানে বিভিন্ন জঙ্গি ডেরা ভাঙা ও জঙ্গি নেতাদের খতম,ধরপাকড়ে আপাতত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি ও নব্য জেএমবি দূর্বল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আল কায়েদার ঘনিষ্ঠ আনসার আল ইসলাম (পূর্বতন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম) ফের সক্রিয়। পুরনো জেএমবি ও নব্য জেএমবি নিজেদের সংগঠিত করার জন্য সামাজিক মাধ্যমে মগজ ধোলাই করছে।

(২) বন্দি জঙ্গিদের মুক্ত করার ছক: গুলশান হামলা পরবর্তী তদন্তে উঠে এসেছে, বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন নব্য জেএমবির বর্তমান শীর্ষ পাঁচ নেতৃত্বের কমিটি (শূরা বোর্ড) অনলাইনে সক্রিয়। এরা হল নব্য জেএমবির নায়েবে আমির (প্রধান নেতা) আবু আহসান হাবিব আল বাঙালি ওরফে লায়ন, রফিক রুহাম, আবু আদনান, আবু উনাইস ও আবু আহসান। এদের লক্ষ্য সংগঠনের বন্দি সদস্যদের মুক্ত করার ছক তৈরি, অনলাইনে জঙ্গিবাদ প্রচার। তদন্তকারীরা মনে করছেন, এক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ২০২২ সালের ২০ নভেম্বর পুরান ঢাকার চিফ জুডিয়িশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত চত্বর পুলিশের কাছ থেকে দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত এবং আবু সিদ্দিক সোহেলকে ছিনিয়ে নেয় তাদের সহযোগীরা। তাদের খোঁজ মেলেনি।

বাংলাদেশি জঙ্গি জাল পানাগড় সেনা ঘাঁটি থেকে মিজোরাম, বেঙ্গালুরুতে হামলার ছক?

(৩) নজরে বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ: ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশাল এলাকায় আদি জেএমবি সংগঠনের জঙ্গিদের পুলিশের ভ্যান থেকে ছিনতাই করা হয়। সংগঠনটির শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন ভারতে আত্মগোপনে আছে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে তার নেতৃত্বে ভারতে ঘাঁটি বানিয়ে সেই বছরই বাংলাদেশে হামলার ছক হয়েছিল। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পূর্ব বর্ধমান জেলার সদর শহর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে একটি বাড়িতে বিস্ফোরণের তদন্ত ধরে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ ও বাংলাদেশ সরকার জানিয়েছে, বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণের সঙ্গে ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হামলার নিবিড় যোগসূত্র আছে।

সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমান জেলার মানকর থেকে ধরা পড়ে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ফরাজ। তাকে জেরা করে দেখা যাচ্ছে ভারতের অন্যতম সামররিক ঘাঁটি পানাগড়ের (পশ্চিম বর্ধমান জেলা) কাছেই জঙ্গি উপস্থিতির প্রমাণ। উত্তর পূর্বাঞ্চলের মিজোরাম থেকে দক্ষিণ ভারতে আনসার জঙ্গিদের সংযোগসূত্র মিলেছে।

Purba Bardhaman: কাঁকসায় ধৃত ছাত্রের সঙ্গে আনসার জঙ্গি যোগ, বাংলাদেশি সংগঠনটির নিশানায় এপারের মুক্তমনা লেখকরা

গুলশান হামলার পর বাংলাদেশের গোয়েন্দা তথ্যে উঠে এসেছিল আক্রমণের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ভারত থেকে ঢুকিয়েছিল জঙ্গিরা। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও শিবগঞ্জ পেরিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশে। চিকিতসা করানোর অছিলায় হামলাকারীদের পাঁচ জনের দুজন কলকাতার উপকণ্ঠে সাময়িক সময় ছিল।