ওয়াশিংটন: দক্ষিণ এশিয়া নীতির অন্যতম প্রভাবশালী মার্কিন বিশ্লেষক ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত কূটনৈতিক উপদেষ্টা অ্যাশলে টেলিসকে (৬৪) গোপন প্রতিরক্ষা নথি অবৈধভাবে মজুত রাখার অভিযোগে গ্রেফতার করেছে মার্কিন বিচার বিভাগ। আদালতের প্রকাশিত নথি অনুসারে, ভার্জিনিয়ার ভিয়েনায় তাঁর বাসভবন থেকে উদ্ধার হয়েছে এক হাজারেরও বেশি ‘টপ সিক্রেট’ ও ‘সিক্রেট’ শ্রেণির সরকারি নথি।
বুশ জমানায় সামলেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ পদ
টেলিস দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে আমেরিকা ও ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্যতম শ্রদ্ধেয় কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত৷ গত সপ্তাহান্তে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়৷ সোমবার অভিযুক্ত হন তিনি। জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সময় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন টেলিস। এফবিআইয়ের হলফনামা অনুযায়ী, সম্প্রতি তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের অবৈতনিক উপদেষ্টা এবং পেন্টাগনের Office of Net Assessment-এর কনট্রাক্টর হিসেবেও যুক্ত ছিলেন।
ওয়াশিংটনের প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক Carnegie Endowment for International Peace-এর সিনিয়র ফেলো হিসেবে তাঁর আন্তর্জাতিক পরিসরে পরিচিতি ছিল সুবিস্তৃত। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর টেলিসের গ্রেফতার নিশ্চিত করলেও কোনও মন্তব্য করেনি।
জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগ Ashley Tellis arrested secret documents
আদালতের নথিতে দাবি করা হয়েছে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে টেলিস মার্কিন প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রক থেকে গোপন সামরিক নথি প্রিন্ট করে বাইরে নিয়ে যান। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গিয়েছে, নথিভর্তি চামড়ার ব্রিফকেস হাতে তিনি দফতর থেকে বেরিয়ে আসছেন।
অক্টোবরের ১১ তারিখে এফবিআইয়ের তল্লাশিতে তাঁর বাড়ির বিভিন্ন স্থানে-বেসমেন্টের ডেস্ক, তালাবদ্ধ ফাইলিং ক্যাবিনেট, এমনকি কালো প্লাস্টিকের ব্যাগেও গোপন নথি পাওয়া যায়। টেলিস নিজে তদন্তে সহযোগিতা করেন, নিজের আঙুলের ছাপ দিয়ে ল্যাপটপ আনলক করেন ও ক্যাবিনেটের চাবি দেন।
চিনা যোগাযোগের অভিযোগে আরও চাঞ্চল্য
মামলাটি আরও গভীরতা পেয়েছে টেলিসের বিরুদ্ধে ওঠা আরেকটি অভিযোগে—চিনা সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে গোপন বৈঠকের সূত্রে। এফবিআইয়ের দাবি, গত ১৫ সেপ্টেম্বর ভার্জিনিয়ার ফেয়ারফ্যাক্সে এক রেস্তরাঁয় টেলিসের সঙ্গে চিনা কর্মকর্তাদের দেখা হয়েছিল। বৈঠকে তিনি হাতে একটি ম্যানিলা খাম নিয়ে ঢুকেছিলেন, কিন্তু ফেরার সময় সেটি আর ছিল না।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসেও ওয়াশিংটনের শহরতলিতে এক ডিনার বৈঠকে তাঁকে চিনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইরান-চিনা সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে শোনা যায় বলে আদালতের নথিতে উল্লেখ রয়েছে। এমনকি গত ২ সেপ্টেম্বর এক বৈঠকে টেলিস নাকি চিনা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ‘উপহার ব্যাগ’ও গ্রহণ করেছিলেন।
মার্কিন অ্যাটর্নি লিন্ডসে হ্যালিগান বলেন, “আমেরিকার নিরাপত্তা রক্ষা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। এই মামলার অভিযোগগুলি দেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোর জন্য গুরুতর হুমকি।” দোষী প্রমাণিত হলে টেলিসের সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড ও ২,৫০,০০০ ডলার জরিমানা হতে পারে।
ভারত-সম্পর্কিত অবস্থান ও বিতর্কিত মত
এই গ্রেফতারের প্রেক্ষিতে আবার আলোচনায় এসেছে টেলিসের সাম্প্রতিক একটি প্রবন্ধ। চলতি বছরের ১৭ জুন Foreign Affairs পত্রিকায় প্রকাশিত লেখায় তিনি বলেছিলেন, ভারতের বহুমেরু বিশ্ব গঠনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবতার তুলনায় অনেক বেশি উচ্চাভিলাষী। তাঁর মতে, চিনের অর্থনৈতিক মাপকাঠির কাছাকাছি পৌঁছাতে ভারতকে এখনও বহু পথ পাড়ি দিতে হবে।
‘India’s Great Power Delusions’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি সতর্ক করেছিলেন-যদি ভারত ও আমেরিকা উভয়ই ক্রমশ অগণতান্ত্রিক পথে এগোয়, তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, যা এতদিন উভয়েরই মঙ্গল সাধন করেছে তা ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
অ্যাশলে টেলিস কে?
মুম্বই-এ জন্ম অ্যাশলে টেলিসের৷ তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তনী। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০১ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এই নীতিবিদ রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট-উভয় শিবিরের সরকারকেই দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক নীতিতে পরামর্শ দিয়েছেন।
ওয়াশিংটন, নয়াদিল্লি ও বেইজিং, তিন মহাদেশীয় রাজধানিতেই তাঁর প্রভাব ছিল দৃশ্যমান। অথচ সেই অভিজ্ঞ নীতিবিদই এখন জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত, এক এমন ঘটনায় যার অভিঘাত কাঁপিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক অন্দরমহল।