কলকাতা: উৎসবের মরসুমে বাঙালির ঘরে ঘরে সাজে আনন্দের মেলা, শঙ্খধ্বনি আর ঢাকের শব্দে মুখরিত হয় বাংলার গ্রাম থেকে শহর। কিন্তু এই উৎসবের আবহেই বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক পুরোহিত ও ঢাকিদের (Priests and Dhakis) বুক ভরা আনন্দের বদলে এখন জায়গা নিচ্ছে আতঙ্ক। দুর্গাপুজোর সময় অন্য রাজ্যে গিয়ে পূজা পরিচালনা বা ঢাক বাজানো এই মানুষগুলির বহু বছরের প্রথা। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্র, গুজরাট, দিল্লি ও রাজস্থানের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি ভাষাভাষী অভিবাসীদের হয়রানির অভিযোগ সামনে আসায় তাঁদের মনে দানা বাঁধছে নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা।
উৎসবের মৌসুমে পূজা কমিটিগুলির ডাক পেয়ে দেশের নানা প্রান্তে পুরোহিতরা পূজার আয়োজন করতে যান, আর ঢাকিরা তাঁদের সুরের তালে মেতে তোলে পুজোর মণ্ডপ। কিন্তু এই বছর অনেকের মনেই প্রশ্ন—নিজের মাতৃভাষা বলার অপরাধে তাঁদের কি হেনস্থার শিকার হতে হবে?
উত্তর ২৪ পরগনার আশোকনগরের এক অভিজ্ঞ ঢাকি মিতালি বারুই জানান, “আমরা প্রতি বছর এই সময়ে নতুন পোশাক, বাচ্চাদের বই, সংসারের খরচের জন্য এই উপার্জনের উপর ভরসা করি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে নিজের পরিচয় প্রমাণ করতে এত নথি নিয়ে বেরোতে হবে, সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।”
ঢাকি দলের পরিচালক বাপি দাস বলেন, “আমরা ইতিমধ্যেই দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, চেন্নাই ও গुवাহাটি থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছি। অ্যাডভান্স টাকাও পেয়েছি, তাই যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। তবে দলের অনেক সদস্য দ্বিধায় ভুগছেন।” তিনি আরও জানান, তাঁদের দলের প্রায় ১০০ জন ঢাকি দুর্গাপুজোর সময় প্রায় এক সপ্তাহ কাজ করেন, প্রত্যেকে ২০,০০০ থেকে ২৫,০০০ টাকা আয় করেন। এই আয় তাঁদের সারা বছরের সংসার চালানোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল থেকে পুরোহিত অশোক মিশ্র বলেন, “আগে আমরা শুধু পূজার বই আর সামগ্রীর তালিকা নিয়ে বেরোতাম। এ বছর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, এমনকি জমির কাগজ পর্যন্ত সঙ্গে রাখতে হবে। আমাদের মতো ধর্মীয় সেবাদাতাদের সন্দেহের চোখে দেখা অত্যন্ত অপমানজনক।”
বিগত কয়েক মাসে বিভিন্ন রাজ্যে বাঙালি ভাষাভাষীদের আটকানো, জিজ্ঞাসাবাদ ও হেনস্থার অভিযোগ তাঁদের ভয় আরও বাড়িয়েছে। সাংস্কৃতিক কর্মীরা জানাচ্ছেন, তাঁরা প্রায়ই ‘অবৈধ’ বা ‘বহিরাগত’ আখ্যা পেয়েছেন শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে।
এ প্রসঙ্গে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা বলেন, “যাঁরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে দেশের নানা প্রান্তে যান, তাঁদের যদি নিরাপত্তাহীনতা বোধ হয়, সেটা অত্যন্ত লজ্জাজনক ও অসাংবিধানিক।” অন্যদিকে বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, এটি বৃহত্তর একক সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার রাজনীতির অঙ্গ।
বিজেপি নেতৃত্ব অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাঁদের বক্তব্য, “বড় মেলা বা উৎসবের সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানোই স্বাভাবিক। কোনও বিশেষ ভাষাভাষীকে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে না।”
কিন্তু মাঠের বাস্তব চিত্র বলছে ভিন্ন কথা। ঢাকি থেকে পুরোহিত—সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন, অথচ জীবিকার জন্য এই যাত্রা বন্ধ করার সুযোগ নেই। দুর্গাপুজোর আগমনী সুরে আনন্দের স্রোত বইলেও, সেই সুরে মিশে আছে বাংলার সাংস্কৃতিক দূতদের নিরাপত্তা ও সম্মানের দাবি।