পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ (Murshidabad) জেলায় ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে চলমান বিক্ষোভের মধ্যে ভয়াবহ সহিংসতায় তিনজনের প্রাণহানি ঘটেছে। শনিবার সকালে জাফরাবাদে, যা সামশেরগঞ্জ থানার অধীনে, এক বাবা ও তার ছেলেকে তাদের নিজ বাড়িতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া, এক যুবক গুলির আঘাতে মারা গেছেন। এই ঘটনায় জেলায় উত্তেজনা বিরাজ করছে, যদিও পুলিশ ও প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।
জাফরাবাদের হরগোবিন্দ দাস (৬০) এবং তাঁর ছেলে চন্দন দাস (৪৫)-এর পরিবার জানিয়েছে, শনিবার সকালে হঠাৎ একদল দুষ্কৃতী তাদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। তারা বাড়িতে ঢুকে লুটপাট শুরু করে এবং হরগোবিন্দ ও চন্দনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তাঁদের মৃত্যু হয়। একই দিনে, সামশেরগঞ্জের ধুলিয়ানে গুলিবিদ্ধ এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনাগুলি ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে, যা জেলার বিভিন্ন এলাকায় হিংসার রূপ নিয়েছে।
ইংরেজি নিউজ১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এখনও পর্যন্ত ১১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। নিমতিতা, সামশেরগঞ্জ, জঙ্গিপুর, সুতি এবং জাফরাবাদে উত্তেজনা অব্যাহত থাকলেও, রেলওয়ে পুলিশ ফোর্স (আরপিএফ) এবং সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনী (বিএসএফ) এলাকায় মোতায়েন রয়েছে। আইএএনএস-কে দেওয়া এক বিবৃতিতে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ মহানির্দেশক (ডিজিপি) রাজীব কুমার জানিয়েছেন, “জঙ্গিপুরে গতকাল থেকে অশান্তির পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। সাম্প্রদায়িক অস্থিরতাও দেখা দিয়েছে। কোনও ধরনের গুন্ডামি সহ্য করা হবে না। আমরা পরিস্থিতির সঙ্গে কঠোরভাবে মোকাবিলা করছি। মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।” তিনি জনগণের কাছে গুজব এড়িয়ে শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শনিবার ওয়াকফ বিলের বিরোধিতা করে স্পষ্ট জানিয়েছেন, তাঁর সরকার রাজ্যে এই আইন কার্যকর করবে না। এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, “প্রতিটি মানুষের জীবন মূল্যবান। রাজনীতির জন্য দাঙ্গা উসকে দেবেন না। যারা দাঙ্গা উসকে দিচ্ছেন, তারা সমাজের ক্ষতি করছেন। মনে রাখবেন, যে আইন নিয়ে অনেকে উত্তেজিত, সেটি আমরা করিনি। এই আইন কেন্দ্রীয় সরকার করেছে। তাই উত্তর আপনাদের কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে চাওয়া উচিত।” তিনি সকল ধর্মের মানুষকে শান্ত থাকার এবং সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছেন।
ওয়াকফ (সংশোধনী) আইন, ২০২৫, গত সপ্তাহে সংসদের উভয় কক্ষে দীর্ঘ বিতর্কের পর পাস হয় এবং ৫ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সম্মতি পায়। এই আইন ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনা ও তদারকি সংক্রান্ত ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইন সংশোধন করে, যেখানে রেকর্ড রক্ষণাবেক্ষণ, বিরোধ নিষ্পত্তি এবং তদারকি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিরোধী দলগুলি এই আইনকে “মুসলিম বিরোধী” এবং “সংবিধানবিরোধী” বলে সমালোচনা করেছে, যদিও কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, এটি ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা বাড়ানোর লক্ষ্যে করা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদে সহিংসতার ঘটনায় রাজনৈতিক তরজাও তীব্র হয়েছে। বিজেপি রাজ্য সরকারের উপর আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলেছে। রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে “ভারতের সবচেয়ে ব্যর্থ মুখ্যমন্ত্রী” বলে আখ্যা দিয়ে দাবি করেছেন, তাঁর শাসনে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। তিনি এই সহিংসতাকে “জিহাদি শক্তির পরিকল্পিত আক্রমণ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, সুতি এবং সামশেরগঞ্জে টহল চলছে এবং কাউকে জমায়েত করতে দেওয়া হচ্ছে না। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব এড়িয়ে চলার জন্যও জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিকে, সহিংসতায় আহত এক কিশোরকে কলকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের এই ঘটনা রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে, এবং অনেকে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ কামনা করছেন। রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে পাল্টাপাল্টি অভিযোগের মধ্যে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকার এবং বিরোধী দলগুলির সংযমী ভূমিকা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।