সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্ট ঘিরে পশ্চিম মেদিনীপুরের ডেবরা কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীর আবারও রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে। বুধবার সকালে তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে লিখেছেন, “#NepalCrisis কবে যে আমাদের দেশের তানাশাহীদের একই হাল হবে! আর দুর্নীতির শিরোমণিদের ফাইল খুলে যাবে!!! আর কবে? আর কবে? আপনারাও কি আমার মত স্বপ্ন দেখেন?”
হুমায়ুন কবীরের এই পোস্ট ঘিরে নেটমাধ্যমে ঝড় উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, শাসকদলের একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি প্রকাশ্যে এমন মন্তব্য করলে তা কোন দিকে ইঙ্গিত করছে? নেপালে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতির সঙ্গে ভারতে ক্ষমতাসীনদের তুলনা টেনে এনে তিনি কি নিজের দলের বিরুদ্ধেই কথা বললেন? নাকি কেন্দ্রীয় শাসকদের প্রতি তাঁর আক্রমণ—তা নিয়ে চলছে প্রবল জল্পনা।
হুমায়ুন কবীরের অতীত
হুমায়ুন কবীর রাজনীতিতে আসার আগে একজন খ্যাতনামা আইপিএস অফিসার ছিলেন। দীর্ঘদিন পুলিশ প্রশাসনে কাজ করার পর ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে জয়লাভ করেন। প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা থাকায় বিধানসভায় তাঁর অবস্থান বরাবরই কিছুটা আলাদা ছিল। তবে সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান ও মন্তব্যে তিনি যে স্পষ্টভাষী, তা তাঁর আগের একাধিক বক্তব্যেই প্রকাশ পেয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া
তাঁর পোস্টের নীচে একের পর এক মন্তব্য আসতে থাকে। সৈকত পাল নামের এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, “সেমসাইড গোল দিলেন তো!” — অর্থাৎ নিজের দলকেই বিপদে ফেলে দিলেন বিধায়ক।
সনৎ ঝা মন্তব্য করেছেন, “আইন প্রতিষ্ঠার লোক হয়েও আপনি এই স্বপ্ন দেখেন! এখন তো আবার আইন তৈরির সঙ্গে যুক্ত। তাও এই স্বপ্ন দেখেন।”
অন্যদিকে সিমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “দেখি তো, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ের ক্ষেত্রেই দেখি, বিশেষ করে রাজ্যের ক্ষেত্রে এই স্বপ্ন বেশি দেখি।”
সোমা দাস নামে এক মহিলার মন্তব্য আরও স্পষ্ট, “হুম স্যার, কবে যে বাংলার মানুষের এমন চেতনার জাগরণ হবে আর দুর্নীতিগ্রস্ত পিসি ভাইপোকে এমন করে দৌড় করাবে! এই স্বপ্ন দেখি বলে আবার ভেবে বসবেন না যে আমি বিজেপি করি। আমি কোনও দলের সঙ্গে নেই। তবে চাই, বাংলার আগের মতো সম্মান ফিরে পাক।”
রাজনৈতিক মহলে আলোড়ন
তৃণমূলের একজন বিধায়ক প্রকাশ্যে যখন “তানাশাহী” আর “দুর্নীতি”র প্রসঙ্গ তোলেন, তখন তা বিরোধীদের হাতে কার্যত হাতিয়ার। বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব ইতিমধ্যেই মন্তব্য করেছে যে, “নিজেদের দলেই দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৈনিকরাও আর চুপ করে নেই।”
বাম ও কংগ্রেস শিবিরেরও বক্তব্য, তৃণমূলের ভেতরে ক্ষোভ জমা হচ্ছে। একজন প্রাক্তন আইপিএস যখন নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সামনে এনে ভারতের শাসকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তখন বোঝাই যাচ্ছে পরিস্থিতি ভেতরে ভেতরে অস্থির।
হুমায়ুনের ইঙ্গিত কোথায়?
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, হুমায়ুন কবীরের এই মন্তব্য দ্ব্যর্থক। তিনি সরাসরি কেন্দ্র সরকারকে নিশানা করেছেন নাকি রাজ্য সরকারকেও আক্রমণ করেছেন—তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাঁর বক্তব্যে “তানাশাহ” শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়েছে। বিজেপি বিরোধীরা মনে করছে, এটি মোদী সরকারের দিকে ইঙ্গিত। অন্যদিকে, ফেসবুকের মন্তব্য ঘিরে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষ বরং রাজ্যের শাসকদের দিকেই আঙুল তুলছেন।
দলের অস্বস্তি
তৃণমূল কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অবশ্য এ নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। এখনও পর্যন্ত রাজ্য নেতৃত্বের তরফে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে সূত্রের খবর, উচ্চ নেতৃত্ব হুমায়ুন কবীরকে সতর্ক করেছেন যে এ ধরনের মন্তব্য করলে বিরোধীরা সুযোগ নেবে।
বিরোধী শিবিরে উচ্ছ্বাস
বিজেপি নেত্রী অগ্নিমিত্রা পল সাংবাদিকদের সামনে বলেন, “তৃণমূলেরই একজন বিধায়ক যখন দুর্নীতির ফাইল খোলার স্বপ্ন দেখেন, তখন প্রমাণ হয় আমরা যা বলছিলাম তাই সত্যি। জনগণই তৃণমূলকে তাড়াবে।”
বামফ্রন্ট নেতা সুজন চক্রবর্তীও কটাক্ষ করে বলেছেন, “হুমায়ুন কবীর সাহেব দেরিতে হলেও সত্যিটা বুঝেছেন।”
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া
ডেবরা থেকে কলকাতা পর্যন্ত সাধারণ মানুষের মধ্যে এই পোস্ট নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকেই বলছেন, দুর্নীতি, স্বজনপোষণ আর রাজনৈতিক সন্ত্রাসে মানুষ বিরক্ত। কেউ কেউ আবার মনে করছেন, একজন বিধায়ক হিসেবে হুমায়ুন কবীরের উচিত ছিল সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস রেখে গঠনমূলক কথা বলা, বিপ্লবের স্বপ্ন নয়।
হুমায়ুন কবীরের ফেসবুক পোস্ট হয়তো কয়েক লাইনের, কিন্তু তার অভিঘাত বহুদূর পৌঁছেছে। নেপালের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কেন্দ্র করে তিনি যে তুলনা টেনেছেন, তা নিঃসন্দেহে রাজ্য ও দেশের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। এখন দেখার বিষয়, তৃণমূল নেতৃত্ব তাঁকে কতটা ছাড় দেয় এবং তিনি নিজে তাঁর মন্তব্যের ব্যাখ্যা দেন কি না।