কলকাতা: ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর ‘গড়’ ভবানীপুরেই প্রতিহত করতে মরিয়া পদ্মশিবির। এই লক্ষ্যেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর উপর ভবানীপুর জয়ের রণকৌশল রচনার ভার দিয়েছে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব। আর সেই দায়িত্ব কাঁধে নিয়েই নন্দীগ্রামের বিধায়ক শুরু করেছেন নিখুঁত বুথস্তরের ভোট পরিসংখ্যান ও সমাজভিত্তিক সমীক্ষা। বিজেপি সূত্রে খবর, ইতিমধ্যেই সেই সমীক্ষার প্রাথমিক রিপোর্ট তাঁর হাতে এসে গিয়েছে (suvendu adhikari started survey in bhabanipur)।
ভবানীপুর বিধানসভা বহু ভাষাভাষী ও বহু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাসস্থল৷ এই বৈচিত্র্যই একে অনেকের চোখে ‘মিনি ভারতবর্ষ’ করে তুলেছে। শুভেন্দুর নির্দেশেই যে সমীক্ষা চালানো হয়েছে, সেখানে শুধু ধর্ম নয়, ভাষা, জাতি ও সম্প্রদায়ভিত্তিক ভোটার বিন্যাসও খতিয়ে দেখা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ভবানীপুরে সবচেয়ে বেশি ভোটার কায়স্থ সমাজের, ২৬.২ শতাংশ। মুসলিম ভোটার ২৪.৫ শতাংশ, পূর্বাঞ্চলীয় সম্প্রদায়ের ১৪.৯ শতাংশ, মারোয়াড়ি ১০.৪ শতাংশ ও ব্রাহ্মণ ভোটার রয়েছেন ৭.৬ শতাংশ। এই তথ্যের ভিত্তিতেই বিজেপি ভবানীপুরের রাজনৈতিক কৌশল সাজাতে চলেছে।
এক বিজেপি নেতা জানিয়েছেন, “শুভেন্দুবাবু প্রতিটি বুথে কোন ভাষাভাষী বা সম্প্রদায় কত শতাংশ রয়েছে, তা জানতে চেয়েছেন। সমীক্ষার রিপোর্ট আপাতত গোপন রাখা হয়েছে। তবে রণনীতির মূল কারিগর তিনিই।”
সম্প্রদায়ভিত্তিক প্রচারে শুভেন্দুর দৃষ্টান্তমূলক কৌশল
সমীক্ষা অনুযায়ী, ভবানীপুরে ওড়িয়া, গুজরাটি ও মারোয়াড়ি ভোটারদের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন গত এপ্রিলেই ওড়িয়াপাড়ায় ‘উৎকল দিবস’ উপলক্ষে ওড়িশার যুব মোর্চা সভাপতি অভিলাষ পণ্ডাকে এনে ওড়িয়া ভোটারদের সঙ্গে জনসংযোগ করানো হয়। আবার গুজরাটের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণীর মৃত্যুতে আয়োজিত স্মরণসভায় গুজরাটি সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় হাজির ছিলেন শুভেন্দু নিজেই।
বিজেপি নেতৃত্ব সূত্রে খবর, ভবানীপুরে বিভিন্ন সম্প্রদায়ভিত্তিক জনসংযোগে ভবিষ্যতে আরও জাতীয় নেতাদের মাঠে নামানো হতে পারে। সমীক্ষা অনুযায়ী, কে কখন, কোন ওয়ার্ড বা সম্প্রদায়ের কাছে যাবেন—তা-ও নির্ধারণ করে দেওয়া হবে।
ভোটের অঙ্কে BJP-র ভরসা ও আশঙ্কা
ভবানীপুরে বিজেপির সাম্প্রতিক ফলাফলে কিছুটা ভরসার জায়গা আছে। ২০১৪ সালে তথাগত রায় দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে মাত্র ১৭৬ ভোটে তৃণমূল প্রার্থীকে পিছনে ফেলেছিলেন। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর ওয়ার্ড ৭৩-তেও জয় পেয়েছিল বিজেপি। ২০১৯ সালে চন্দ্র বসু ছয়টি ওয়ার্ডে এগিয়েছিলেন। তবে ২০২১ সালে উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী আটটি ওয়ার্ডেই জয় পান। বিজেপি অভিযোগ করেছিল, সেখানে ব্যাপক রিগিং ও সন্ত্রাস হয়েছে, যদিও তা তদন্তের আওতায় আসেনি।
সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটেও ভবানীপুরে পাঁচটি ওয়ার্ডে এগিয়েছে বিজেপি, যদিও সমগ্র আসনে মালা রায় ৬,৩৩৪ ভোটে জয় পান দেবশ্রী চৌধুরীর বিরুদ্ধে।
বিজেপির অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং ‘বাঙালি-অবাঙালি’ প্রশ্ন
নতুন মণ্ডল সভাপতি নিয়োগের পরেও ভবানীপুরে বিজেপির অন্দরমহলে ক্ষোভ উঁকি দিচ্ছে। তিনটি মণ্ডলেই বিহারী নেতাদের বসানো হয়েছে বলে ক্ষুব্ধ অনেক বাঙালি কর্মী। এক নেতার কথায়, “শুভেন্দুদা শুরু থেকেই ভবানীপুরে অবাঙালি নেতৃত্বের আধিক্যে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন। এখন তিনিই নেতৃত্বে, আশা করছি সমীক্ষার ভিত্তিতে সামাজিক ভারসাম্য ঠিক করবেন।”
নিচুতলার অনেক বিজেপি কর্মীর ধারণা, ভবানীপুরে ভোট পরিচালনার জন্য যে কৌশল সাজানো হবে, সেখানে এই ‘সামাজিক সমীকরণ’-এর প্রতিফলন স্পষ্ট হবে। কোন সম্প্রদায়ের নেতাকে কোথায় কতটা ব্যবহার করতে হবে, তা সমীক্ষার উপরই নির্ভর করবে।