পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাতার স্বাধীনতা হরণের অভিযোগ উঠেছে কলকাতায় ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ চলচ্চিত্রের ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়ার ঘটনায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা সুকান্ত মজুমদার এই ঘটনাকে ‘অগণতান্ত্রিক’ এবং ‘চলচ্চিত্র নির্মাতার কণ্ঠরোধ’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শনিবার (১৬ আগস্ট, ২০২৫) কলকাতার আইটিসি রয়্যাল বেঙ্গল হোটেলে এই ট্রেলার প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই এই অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়, যা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাতা বিবেক রঞ্জন আগ্নিহোত্রী এবং বিজেপি নেতারা তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মজুমদার এই ঘটনাকে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিযোগ করেছেন৷
ঘটনার বিবরণ
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ একটি আলোচিত চলচ্চিত্র, যা ১৯৪৬ সালের অবিভক্ত বাংলার সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, বিশেষ করে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে এবং নোয়াখালি দাঙ্গার মতো ঘটনাগুলোর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন অনুপম খের, দর্শন কুমার এবং পল্লবী জোশী। ট্রেলার প্রকাশের জন্য কলকাতার আইটিসি রয়্যাল বেঙ্গল হোটেলে একটি বড় আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ পরই হঠাৎ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিবেক আগ্নিহোত্রী অভিযোগ করেছেন যে এই বাধা স্থানীয় প্রশাসন এবং পুলিশের নির্দেশে দেওয়া হয়েছে, যা তিনি ‘স্বৈরাচারী’ এবং ‘ফ্যাসিবাদী’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
আগ্নিহোত্রী মিডিয়ার সামনে বলেন, “আমরা চলচ্চিত্র নির্মাতা, অপরাধী নই। সমস্ত অনুমতি এবং অনুমোদন নিয়ে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে হঠাৎ বলা হলো যে আমরা ট্রেলার প্রকাশ করতে পারব না। এটি যদি স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ না হয়, তবে কী?” তিনি আরও অভিযোগ করেন যে কিছু লোক এসে অনুষ্ঠানের জন্য ব্যবহৃত তার কেটে দিয়েছে, যা তিনি রাজ্যের শাসক দলের নির্দেশে ঘটেছে বলে মনে করেন।
সুকান্ত মজুমদারের প্রতিক্রিয়া
কেন্দ্রীয় শিক্ষা ও উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। তিনি এক্স প্ল্যাটফর্মে লিখেছেন, “সত্যজিৎ রায়ের ভূমিতে পশ্চিমবঙ্গে এমন একটি লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, যা গণতান্ত্রিক শিষ্টাচারের সীমা ভেঙে দিয়েছে। এটি কেবল লজ্জাজনক নয়, বরং বাংলার বর্তমান জঙ্গলরাজ, অরাজকতা এবং স্বৈরাচারী অহংকারের একটি ভয়াবহ স্মারক।”
এএনআই-এর সঙ্গে কথা বলার সময় মজুমদার বলেন, “এটি পশ্চিমবঙ্গের প্রকৃত চিত্র, যেখানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব নেই। চলচ্চিত্র নির্মাতার কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে পুলিশ এই কাজ করেছে। এটি তাঁর ষড়যন্ত্র, যিনি চান না বাংলার প্রকৃত ইতিহাস প্রকাশিত হোক।” তিনি আরও বলেন, “গণতন্ত্রে কাউকে চলচ্চিত্র নির্মাণে বাধা দেওয়া যায় না। এটি বাক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং নির্মাতার স্বাধীনতার অংশ।”
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া
তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং বিজেপি ও আগ্নিহোত্রীকে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাংলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য বিতর্ক সৃষ্টির অভিযোগ করেছে। টিএমসি মুখপাত্র দেবাংশু ভট্টাচার্য বলেন, “এর আগে ‘দ্য কাশ্মীর ফাইলস’ মুক্তি পেয়েছিল, তবুও বিজেপি নির্বাচনে হেরেছিল। এখন তারা ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ নিয়ে একই কৌশল অবলম্বন করছে। বাংলার মানুষ এই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চলচ্চিত্রে আগ্রহী নয়।”
টিএমসি নেতা কুনাল ঘোষ বলেন, “এই চলচ্চিত্রটি বাংলাকে কলঙ্কিত করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোতে দুর্নীতির উপর চলচ্চিত্র তৈরি করা উচিত।” তিনি আরও পরামর্শ দেন যে হোটেলের সঙ্গে পেমেন্ট বা অনুমতি সংক্রান্ত সমস্যা থাকতে পারে, যা এই বাধার কারণ হতে পারে।
চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাপট এবং বিতর্ক
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা এবং নোয়াখালি গণহত্যার মতো ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর উপর ভিত্তি করে নির্মিত। আগ্নিহোত্রী দাবি করেছেন যে এই চলচ্চিত্র ইতিহাসের সত্য তুলে ধরার জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং এর কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। তিনি বলেন, “আমি গল্পকার, এবং এই চলচ্চিত্রটি তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি। কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।” তবে, সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন যে চলচ্চিত্রের কিছু সংলাপ সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে।
এক্স প্ল্যাটফর্মে এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। বিজেপি নেতা এবং অভিনেতা মিথুন চক্রবর্তীও এই ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, “এত বড় হোটেলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে, এটা কল্পনাও করা যায় না।”
‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ট্রেলার প্রকাশে বাধা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির উপর নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সুকান্ত মজুমদার এবং বিজেপি এই ঘটনাকে বাক স্বাধীনতার উপর হামলা হিসেবে দেখছেন, যেখানে তৃণমূল কংগ্রেস এটিকে রাজনৈতিক প্রচারণার অংশ বলে দাবি করছে। এই ঘটনা বাংলার গণতান্ত্রিক পরিবেশ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বাধীনতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। আগামী ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫-এ চলচ্চিত্রটি মুক্তির পর এই বিতর্ক আরও তীব্র হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকার এবং প্রশাসনের স্বচ্ছ ভূমিকা প্রয়োজন, যাতে শিল্পীদের কণ্ঠরোধ না হয়।